স্মৃতিশক্তি বাড়ানোর এক প্রাচীন কৌশল: ‘মেমরি প্যালেস’।
আমাদের দৈনন্দিন জীবনে, পড়াশোনা থেকে শুরু করে কর্মক্ষেত্র— স্মৃতিশক্তির গুরুত্ব অপরিসীম। অনেক সময় মনে হয়, যদি একটু বেশি মনে রাখতে পারতাম, তাহলে ভালো হতো।
প্রাচীনকালে মানুষ তাদের স্মৃতিকে শাণিত করতে এক বিশেষ কৌশল ব্যবহার করত, যা ‘মেমরি প্যালেস’ বা ‘স্মৃতির মহল’ নামে পরিচিত। এই কৌশলটি এখন শুধু অতীতের গল্প নয়, বরং আধুনিক বিজ্ঞানও এর কার্যকারিতা প্রমাণ করেছে। আসুন, জেনে নেওয়া যাক এই বিস্ময়কর কৌশলটি সম্পর্কে।
‘মেমরি প্যালেস’ আসলে কী?
সহজ ভাষায় বলতে গেলে, এটি হলো আপনার পরিচিত কোনো স্থানকে, যেমন— নিজের বাড়ি অথবা কর্মস্থলের একটি দৃশ্যকে, স্মৃতির ভাণ্ডার হিসেবে গড়ে তোলা। আপনি আপনার মস্তিষ্কে একটি মানচিত্র তৈরি করেন, যেখানে তথ্যের সাথে স্থানের একটি সম্পর্ক তৈরি হয়।
উদাহরণস্বরূপ, যদি আপনি একটি মুদিখানার তালিকা মনে রাখতে চান, তাহলে প্রতিটি জিনিসের জন্য আপনার বাড়ির কোনো একটি নির্দিষ্ট স্থানকে নির্বাচন করতে পারেন। যেমন, দুধের কথা মনে রাখতে চাইলে, আপনার মায়ের হাসিখুশি ছবিটিকে কল্পনা করতে পারেন, অথবা আপেলের জন্য আপনার বারান্দার দৃশ্য মনে করতে পারেন।
এই ধরনের দৃশ্যকল্প তৈরি করা তথ্য মনে রাখতে সহায়ক হয়।
ইতিহাসের পাতায় ‘মেমরি প্যালেস’
প্রাচীন গ্রিক কবি সাইমনাইডিস অফ সিওস-এর হাত ধরে এই পদ্ধতির জন্ম। তিনি একটি অনুষ্ঠানে নিহত ব্যক্তিদের মুখচ্ছবি মনে রাখতে এই কৌশল ব্যবহার করেছিলেন।
এরপর রোমান বক্তা সিসেরো তার বক্তৃতা মনে রাখার জন্য এই কৌশল ব্যবহার করেন। শুধু তাই নয়, বিশ্বের বিভিন্ন আদিবাসী সংস্কৃতিতেও এই ধরনের স্মৃতি কৌশল প্রচলিত ছিল।
বিজ্ঞান কী বলে?
সাম্প্রতিক গবেষণায় দেখা গেছে, ‘মেমরি প্যালেস’ কৌশল মস্তিষ্কের স্মৃতি-সংক্রান্ত অংশগুলোকে সক্রিয় করে তোলে। এটি আমাদের স্থানিক নেভিগেশন এবং ভিজ্যুয়াল মেমোরিকে কাজে লাগায়, যা তথ্য মনে রাখার ক্ষমতা বাড়ায়।
বর্তমানে, স্মৃতিশক্তি বাড়ানোর প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণকারীরা এবং স্মৃতিশক্তি বিষয়ক অন্যান্য গবেষণায় এই কৌশল ব্যবহৃত হচ্ছে।
স্মৃতিভ্রংশতা এবং অন্যান্য সমস্যা সমাধানে ‘মেমরি প্যালেস’-এর ব্যবহার
ফ্লোরিডার একটি ইয়ং মেনস ক্রিশ্চিয়ান অ্যাসোসিয়েশন (YMCA)-তে বয়স্ক ব্যক্তিদের স্মৃতিশক্তি বাড়ানোর জন্য এই কৌশল ব্যবহার করা হচ্ছে। স্মৃতিভ্রংশতার প্রাথমিক পর্যায়ে থাকা ব্যক্তিরা এই পদ্ধতিতে উপকৃত হচ্ছেন।
এছাড়া, যারা মস্তিষ্কের আঘাত বা ট্রমা থেকে সেরে উঠছেন, তাদের স্মৃতিশক্তি পুনরুদ্ধারেও এই কৌশল সহায়ক হতে পারে। এমনকি, এটি বিষণ্ণতা এবং পিটিএসডি-র (পোস্ট-ট্রমাটিক স্ট্রেস ডিসঅর্ডার) চিকিৎসায়ও সহায়ক হতে পারে।
বিষণ্ণতা বা উদ্বেগে আক্রান্ত ব্যক্তিরা তাদের ইতিবাচক স্মৃতিগুলোকে একটি ‘মেমরি প্যালেস’-এ সাজিয়ে রাখতে পারেন, যা কঠিন সময়ে তাদের মানসিক শান্তির আশ্রয়স্থল হিসেবে কাজ করে।
যেভাবে শুরু করবেন
‘মেমরি প্যালেস’ তৈরি করা খুব কঠিন কিছু নয়। প্রথমে, আপনার পরিচিত একটি স্থান নির্বাচন করুন, যেমন আপনার ঘর বা কর্মস্থল।
এরপর, সেই স্থানের বিভিন্ন বস্তু বা স্থানকে চিহ্নিত করুন। এখন, আপনি যে তথ্য মনে রাখতে চান, সেগুলোর সাথে এই স্থানগুলোর একটি সম্পর্ক তৈরি করুন।
সম্পর্কটি যত বেশি অদ্ভুত ও কল্পনাপ্রসূত হবে, তথ্য মনে রাখা তত সহজ হবে।
উপসংহার
স্মৃতিশক্তি বাড়ানোর এই প্রাচীন কৌশলটি আমাদের মস্তিষ্কের অসাধারণ ক্ষমতাকে কাজে লাগায়। এটি একদিকে যেমন আমাদের স্মৃতিশক্তিকে শাণিত করে, তেমনি মানসিক স্বাস্থ্য ভালো রাখতেও সাহায্য করে।
তাই, স্মৃতিশক্তি বাড়াতে এবং মস্তিষ্কের স্বাস্থ্য ভালো রাখতে, ‘মেমরি প্যালেস’ কৌশলটি ব্যবহার করে দেখতে পারেন।
সতর্কতা: এই নিবন্ধটি শুধুমাত্র তথ্য প্রদানের উদ্দেশ্যে লেখা হয়েছে। মানসিক স্বাস্থ্য বিষয়ক কোনো সমস্যার ক্ষেত্রে, অনুগ্রহ করে একজন বিশেষজ্ঞের পরামর্শ নিন।
তথ্যসূত্র: ন্যাশনাল জিওগ্রাফিক-এর প্রতিবেদন অবলম্বনে।