অস্কার জয়ী দুটি সিনেমা: লাতিন আমেরিকায় ‘নিখোঁজ’ হওয়া মানুষের হাহাকার
মেক্সিকো সিটি, [তারিখ] — লাতিন আমেরিকায় এখনো গভীর ক্ষত হয়ে আছে হাজার হাজার মানুষের ‘নিখোঁজ’ হয়ে যাওয়ার ঘটনা। মেক্সিকো এবং কলম্বিয়ার মতো দেশগুলোতে দশকের পর দশক ধরে এই বেদনা বয়ে বেড়াচ্ছেন স্বজনহারা মানুষজন। সম্প্রতি অনুষ্ঠিত ৯৭তম অ্যাকাডেমি অ্যাওয়ার্ডসে (অস্কার) এই ট্র্যাজেডিকে কেন্দ্র করে নির্মিত দুটি সিনেমার বিষয় ছিল আলোচনার কেন্দ্রে।
প্রথম সিনেমাটি হলো ব্রাজিলের ছবি ‘আইন্দা এস্তৌ আকি’ (‘আমি এখনো এখানে আছি’)। ১৯৭১ সালে সামরিক শাসনের চরম সময়ে এক বামপন্থী সংসদ সদস্যকে অপহরণের পর তাঁর পরিবারের মর্মান্তিক পরিণতি এতে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে। দ্বিতীয় সিনেমাটি হলো ‘এমিলিয়া পেরেজ’ নামের একটি ফরাসি-মেক্সিকান সিনেমা। এতে এক কাল্পনিক মেক্সিকান মাদক ব্যবসায়ীকে তুলে ধরা হয়েছে, যে অপরাধ জগৎ থেকে মুক্তি পেতে রূপান্তরকামী নারী হয়ে ওঠে এবং মেক্সিকোতে নিখোঁজ হওয়া মানুষদের খুঁজে বের করতে চেষ্টা করে।
মেক্সিকোর জালিস্কো প্রদেশের ‘গুয়েরেরোস বুসকাডোরেস দে জালিস্কো’ (জালিস্কোর অনুসন্ধানকারী যোদ্ধা) নামক সংগঠনের প্রধান ইন্দিরা নাভারো। তিনি নয় বছর আগে নিখোঁজ হওয়া তাঁর ভাইয়ের সন্ধানে এখনো অবিরাম ছুটে চলেছেন। নাভারো বলেন, “আমরা আশা করি, এই সিনেমার মাধ্যমে সমাজের মানুষজন সংবেদনশীল হবেন।”
অস্কারে একাধিক বিভাগে মনোনয়ন পাওয়া সিনেমা দুটি এই সমস্যা বিশ্ববাসীর সামনে তুলে ধরার এক দারুণ সুযোগ এনে দিয়েছে বলে তিনি মনে করেন।
ব্রাজিলের ওয়াল্টার সেলস পরিচালিত ‘আইন্দা এস্তৌ আকি’ সেরা আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র বিভাগে অস্কার জিতেছে। অন্যদিকে, ফরাসি পরিচালক জ্যাক অডিয়ার্ডের ‘এমিলিয়া পেরেজ’ ছিল এবারের আসরের সবচেয়ে বেশি মনোনয়ন পাওয়া সিনেমা। সিনেমাটি সেরা মৌলিক গান এবং সেরা সহ-অভিনেত্রী বিভাগে পুরস্কার জিতেছে, যেখানে অভিনয় করেছেন জো সালদানা।
সেলস এবং অডিয়ার্ডের সিনেমা দুটির একটি সাধারণ দিক ছিল— লাতিন আমেরিকায় ‘নিখোঁজ’ হওয়া মানুষের ঘটনার সঙ্গে জড়িতদের দায়মুক্তি।
‘আইন্দা এস্তৌ আকি’ সিনেমার গল্প :
‘আইন্দা এস্তৌ আকি’ সিনেমাটি তৈরি হয়েছে মার্সেলো রুবেন্স পাইভার লেখা ‘আইন্দা এস্তৌ আকি’ নামক বই অবলম্বনে। মার্সেলো ছিলেন নিখোঁজ হওয়া সাবেক কংগ্রেসম্যান রুবেন্স পাইভার ছেলে। ১৯৭১ সালে রিও ডি জেনিরো থেকে অপহরণের শিকার হওয়ার পর তাঁর আর কোনো খোঁজ পাওয়া যায়নি। ঘটনার পাঁচ দশক পেরিয়ে গেলেও, এই ঘটনার সঙ্গে জড়িত কাউকে এখনো পর্যন্ত বিচারের আওতায় আনা যায়নি।
সংসদ সদস্য রুবেন্স পাইভার স্ত্রী ইউনিস এবং তাঁদের পাঁচ সন্তানেরা বছরের পর বছর ধরে ন্যায়বিচারের জন্য অপেক্ষা করছেন। অবশেষে ঘটনার ৪০ বছর পর তাঁর মৃত্যুর সনদ পাওয়া যায়। এমনকি কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে এই স্বীকৃতি পেতেও দীর্ঘ সময় লেগেছে যে, তিনি সামরিক শাসনের সময় সহিংসতার শিকার হয়ে মারা গেছেন।
এই পুরস্কার একজন নারীর প্রতি উৎসর্গ করা হলো, যিনি স্বৈরশাসকের শাসনের সময় প্রিয়জনকে হারানোর পরও ভেঙে পড়েননি, বরং প্রতিরোধ চালিয়ে গেছেন… তাঁর নাম ইউনিস পাইভা।
মার্সেলো রুবেন্স পাইভা এক সাক্ষাৎকারে বলেন, “বিশ্বজুড়ে মানুষজন তাদের গণতন্ত্রকে স্বৈরতন্ত্রে পরিণত হতে দেখে ভীত। এই সিনেমা গণতন্ত্র এবং মানবাধিকারের গুরুত্ব তুলে ধরে, যা বর্তমানে বেশ দুষ্প্রাপ্য।”
মেক্সিকোতে নিখোঁজ হওয়া মানুষেরা :
‘এমিলিয়া পেরেজ’ সিনেমার কেন্দ্রীয় চরিত্র হলো ‘মানিতাস দেল মান্তে’ (কার্লা সোফিয়া গ্যাসকন)। সে একজন মাদক পাচারকারী। এই চরিত্রে অভিনয় করা ব্যক্তিটি আইনজীবী রিতা কাস্ত্রোর (সালদানা) সঙ্গে মিলে নিখোঁজ হওয়া মানুষদের খুঁজে বের করার চেষ্টা করে। সিনেমায় দেখা যায়, সে কখনোই তার অপরাধের জন্য শাস্তি পায় না। একইসঙ্গে, নিখোঁজ হওয়ার ঘটনার সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিদেরও মেক্সিকোর বিচার ব্যবস্থার আওতায় আনা হয় না।
মেক্সিকোর বাস্তব চিত্রটাও অনেকটা এমনই। সরকারি হিসাব অনুযায়ী, বর্তমানে দেশটিতে ১ লাখ ২৩ হাজার ১৪৭ জন মানুষ নিখোঁজ রয়েছে।
জাতিসংঘের ‘নিখোঁজ হওয়া বিষয়ক কমিটি’ ২০২২ সালের এপ্রিল মাসে মেক্সিকো সফর করে একটি প্রতিবেদন পেশ করে। এতে বলা হয়, দেশটিতে নিখোঁজ হওয়ার ঘটনার মাত্র ২ থেকে ৬ শতাংশের বিচার হয়।
কমিটি জানায়, “সংগঠিত অপরাধ চক্র মেক্সিকোতে মানুষ নিখোঁজ করার প্রধান কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। সরকারি কর্মচারীদের কারো কারো প্রত্যক্ষ অথবা পরোক্ষভাবে এতে জড়িত থাকার প্রমাণ পাওয়া গেছে।”
মেক্সিকোতে ১৯৬০-এর দশকে নিখোঁজ হওয়ার ঘটনা শুরু হয়। তবে ২০০০ সালের পর মাদক পাচার বেড়ে যাওয়ায় এবং তৎকালীন প্রেসিডেন্ট ফেলিপ ক্যালদেরনের (২০০৬-২০১২) সরকার মাদক চক্রের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করার পর এই সংখ্যা দ্রুত বৃদ্ধি পায়।
মেক্সিকোতে অনেক নিখোঁজ ব্যক্তির সন্ধানের কাজটি মূলত তাঁদের পরিবারের সদস্যরা করে থাকেন। সামান্য কিছু অর্থ আর কর্তৃপক্ষের দুর্বল নিরাপত্তার মধ্যে থেকেও তাঁরা অপরাধীদের নিয়ন্ত্রণে থাকা অঞ্চলে গিয়ে প্রিয়জনদের খুঁজে বের করার চেষ্টা করেন।
নাভারো নামের ওই নারীও তেমন একজন। সম্প্রতি তিনি জালিস্কো রাজ্যের একটি গণকবরের কাছে দাঁড়িয়ে কথা বলছিলেন। তিনি বলেন, “আমি আশা করি, অস্কার জয় সারা বিশ্বের জন্য একটি সতর্কবার্তা বয়ে আনবে এবং সবাই জানতে পারবে মেক্সিকোতে আসলে কী ঘটছে।”
তথ্য সূত্র: অ্যাসোসিয়েটেড প্রেস