গাজায় খাদ্য, জ্বালানি ও ঔষধ সরবরাহ বন্ধ করে দেওয়ায় মানবিক বিপর্যয়, বাড়ছে দ্রব্যমূল্য
জেরুজালেম, [তারিখ উল্লেখ করা হলো না] – গাজায় প্রায় ২০ লক্ষ ফিলিস্তিনি বাসিন্দার জন্য খাদ্য, জ্বালানি, ঔষধ ও অন্যান্য জরুরি সরবরাহ বন্ধ করে দিয়েছে ইসরায়েল। এর ফলে সেখানকার বাজারে নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের দাম আকাশছোঁয়া হয়ে উঠেছে। জীবনধারণের জন্য প্রয়োজনীয় সামগ্রীর অভাবে চরম দুর্ভোগে পড়েছেন গাজাবাসীরা। মানবিক সহায়তা সংস্থাগুলো সেখানকার সংকট মোকাবিলায় প্রাণপণে চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে।
জানুয়ারিতে হামাস ও ইসরায়েলের মধ্যে হওয়া যুদ্ধবিরতি চুক্তির প্রথম পর্যায়ে মানবিক সহায়তা কিছুটা পৌঁছানো গেলেও, এখন তা প্রায় বন্ধ হয়ে গেছে। সাহায্যকর্মীরা বলছেন, এর ফলে দুর্ভিক্ষের ঝুঁকি বাড়ছে। গত ১৬ মাসের বেশি সময় ধরে গাজার মানুষজন সম্পূর্ণরূপে বাইরে থেকে আসা সাহায্যের উপর নির্ভরশীল। তাদের খাদ্য, আশ্রয় এবং জরুরি স্বাস্থ্যসেবার জন্য এই সহায়তা অপরিহার্য। বর্তমানে সেখানকার অধিকাংশ মানুষ বাস্তুচ্যুত এবং তাদের জন্য আশ্রয় জরুরি। হাসপাতাল, জল পাম্প, রুটি তৈরির কারখানা, টেলিযোগাযোগ ব্যবস্থা সচল রাখতে জ্বালানির প্রয়োজন, যা এখন দুষ্প্রাপ্য।
ইসরায়েলের দাবি, হামাসকে তাদের প্রস্তাবিত যুদ্ধবিরতির শর্ত মেনে নিতে বাধ্য করতেই এই পদক্ষেপ। ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু মঙ্গলবার (এই প্রতিবেদনের সময় অনুযায়ী) বলেছেন, হামাস যদি নমনীয় না হয়, তাহলে গাজায় বিদ্যুৎ সরবরাহ বন্ধ করার মতো কঠোর পদক্ষেপ নিতেও তারা প্রস্তুত। মানবাধিকার সংস্থাগুলো ইসরায়েলের এই পদক্ষেপকে ‘굶ের নীতি’ হিসেবে বর্ণনা করেছে।
সংকট মোকাবিলায় মানবিক সংস্থাগুলোর তৎপরতা
সংকট শুরুর দুই দিনের মাথায় গাজার পরিস্থিতি কেমন, তা জানতে চাওয়া হলে জানা যায়, সেখানকার পরিস্থিতি খুবই ভয়াবহ। নরওয়েজিয়ান রিফিউজি কাউন্সিলের যোগাযোগ উপদেষ্টা শাইনা লো জানান, গাজায় আশ্রয়হীন মানুষের জন্য পর্যাপ্ত তাঁবুর মজুত নেই। যুদ্ধবিরতির প্রথম পর্যায়ে যে সহায়তা এসেছিল, তা প্রয়োজনের তুলনায় খুবই সামান্য ছিল। তিনি আরও বলেন, ‘যদি সাহায্য যথেষ্ট হতো, তাহলে আশ্রয় ও গরম কাপড়ের অভাবে শিশুদের মৃত্যু হতো না।’ জানা গেছে, প্রথম পর্যায়ে শীতের কারণে ৬ জন শিশুর মৃত্যু হয়েছে।
জাতিসংঘের শিশু বিষয়ক সংস্থা ইউনিসেফের মুখপাত্র জোনাথন ক্রিকস জানিয়েছেন, বর্তমানে তাদের হাতে থাকা সামগ্রীর সঠিক ব্যবহার নিশ্চিত করতে চেষ্টা চালাচ্ছেন তারা। তিনি বলেন, ‘আমাদের কাছে মজুত খুব বেশি নেই, কারণ আমরা কখনো জিনিসপত্র জমিয়ে রাখিনি।’ ক্রিকস সতর্ক করে বলেন, সরবরাহ বন্ধ থাকলে পরিস্থিতি ‘বিপর্যয়কর’ রূপ নেবে।
যুদ্ধবিরতির প্রথম পর্যায়ে মানবিক সংস্থাগুলো দ্রুত ত্রাণ সরবরাহ করে তাদের কার্যক্রম বৃদ্ধি করেছিল। খাদ্য বিতরণ কেন্দ্র, স্বাস্থ্যকেন্দ্র ও পানি সরবরাহ ব্যবস্থা বাড়ানো হয়েছিল। জাতিসংঘের মানবিক সহায়তা সমন্বয় সংস্থা (ওসিএইচএ) জানায়, জ্বালানি সরবরাহ বেড়ে যাওয়ায় কূপ থেকে দ্বিগুণ পানি উত্তোলন করা সম্ভব হয়েছিল।
জাতিসংঘ এবং সংশ্লিষ্ট বেসরকারি সংস্থাগুলো প্রায় ১ লক্ষ তাঁবু সরবরাহ করেছিল, যা দিয়ে বাস্তুচ্যুত হওয়া ফিলিস্তিনিদের আশ্রয় দেওয়ার চেষ্টা করা হয়। কিন্তু ইসরায়েলের অবরোধের কারণে এখন সেই প্রক্রিয়া ব্যাহত হচ্ছে। আন্তর্জাতিক অভিবাসন সংস্থার আঞ্চলিক সংকট সমন্বয়কারী কার্ল বেকার জানিয়েছেন, তাদের গুদামে বর্তমানে ২২,৫০০ তাঁবু রয়েছে, যা গাজায় পাঠানোর অপেক্ষায় আছে। ত্রাণবাহী ট্রাকগুলো তাদের পণ্য ফেরত নিয়ে গেছে, কারণ সেখানে প্রবেশের অনুমতি পাওয়া যাচ্ছে না।
আন্তর্জাতিক উদ্ধার কমিশন জানিয়েছে, তাদের কাছে ৬.৭ টন ঔষধ ও চিকিৎসা সামগ্রী রয়েছে, যা গাজায় পাঠানোর অপেক্ষায় আছে। তবে এখন পর্যন্ত তা সেখানে পৌঁছানো অনিশ্চিত। সংস্থাটির ভাইস প্রেসিডেন্ট বব কিচেন বলেছেন, ‘অবিলম্বে ত্রাণ সরবরাহ স্বাভাবিক করা জরুরি। মানবিক চাহিদা যখন আকাশচুম্বী, তখন সাহায্য কমানো নয়, বরং আরও বেশি সহায়তা প্রয়োজন।’
দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি
জাতিসংঘের মানবিক বিষয়ক দপ্তর মঙ্গলবার জানিয়েছে, অবরোধের কারণে সবজির দাম বেড়েছে। গাজা শহরের একটি বাজারে গিয়ে দেখা যায়, অবরোধ ঘোষণার পরপরই জিনিসপত্রের দাম বাড়তে শুরু করেছে। ব্যবসায়ীরা তাদের পণ্যের দাম বাড়িয়ে দিয়েছেন।
গাজায় অবরোধ ঘোষণার আগে যেখানে চিনির দাম ছিল ৫ শেকেল (বাংলাদেশি মুদ্রায় প্রায় ১৭১ টাকা), এখন তা বেড়ে হয়েছে ১০ শেকেল (প্রায় ৩৪৩ টাকা)। একইভাবে, সিগারেটের দাম ৫ শেকেল (প্রায় ১৭১ টাকা) থেকে বেড়ে হয়েছে ২০ শেকেল (প্রায় ৬৯২ টাকা)। এক কেজি মুরগির মাংসের দাম ২১ শেকেল (প্রায় ৭২৫ টাকা) থেকে বেড়ে হয়েছে ৫০ শেকেল (প্রায় ১,৭৩০ টাকা)। রান্নার গ্যাসের দামও বেড়েছে কয়েকগুণ। ১২ কিলোগ্রামের গ্যাসের দাম ৯০ শেকেল (প্রায় ৩,১০৭ টাকা) থেকে বেড়ে হয়েছে ১,৪৮০ শেকেল (প্রায় ৫১,১৫৬ টাকা)।
২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর হামাসের হামলার পর ইসরায়েল গাজায় দুই সপ্তাহের জন্য সব ধরনের সাহায্য বন্ধ করে দেয়। দক্ষিণ আফ্রিকা আন্তর্জাতিক বিচার আদালতে ইসরায়েলের বিরুদ্ধে গণহত্যার যে অভিযোগ এনেছে, তাতে এই ঘটনাকে একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। ফিলিস্তিনিরা আশঙ্কা করছেন, পরিস্থিতি আবারও সেই সময়ের দিকে যাচ্ছে।
গাজার উত্তরাঞ্চলের বাসিন্দা আবেয়ার ওবায়েদ বলেছেন, ‘আমরা ভয় পাচ্ছি নেতানিয়াহু অথবা ট্রাম্প আগের চেয়েও ভয়াবহ যুদ্ধ শুরু করবেন। কেন তারা সীমান্ত বন্ধ করে দিচ্ছেন? যুদ্ধবিরতি দীর্ঘায়িত করতে হলে তাদের অন্য কোনো সমাধান খুঁজে বের করতে হবে।’
তথ্য সূত্র: অ্যাসোসিয়েটেড প্রেস