শিকাগোর দুই প্রবীণ ক্যাথলিক সন্ন্যাসিনী, সিস্টার প্যাট্রিসিয়া মারফি (৯৫) এবং সিস্টার জোআন পার্চ (৯০), গত ৪০ বছর ধরে অভিবাসী অধিকারের জন্য নিরলসভাবে কাজ করে চলেছেন। তাদের এই অবিরাম সংগ্রাম যেন এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। তারা কোনো কঠিন পরিস্থিতিতেও হার মানতে রাজি নন।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে অভিবাসন নীতির পরিবর্তনের প্রেক্ষাপটে, যেখানে শরণার্থীদের পুনর্বাসন কর্মসূচি বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে এবং আশ্রয়কেন্দ্রগুলির উপরও আঘাত করা হচ্ছে, এই দুই সন্ন্যাসিনী তাদের প্রতিবাদ অব্যাহত রাখার অঙ্গীকার করেছেন। তাদের মতে, যতদিন সৃষ্টিকর্তা তাদের শক্তি যোগাবেন, ততদিন তারা এই লড়াই চালিয়ে যাবেন।
সিস্টার জোআন পার্চ বলেন, অভিবাসীদের প্রতি বিদ্বেষপূর্ণ ভাষা ব্যবহার করা হয়, যা তাদের ব্যথিত করে। তিনি আরও যোগ করেন, তাদের পরিবারগুলোও উদ্বেগে রয়েছে। কোভিড-১৯ পরিস্থিতি কিছুটা শান্ত হওয়ার পর, তারা অবসর গ্রহণের কথা ভেবেছিলেন। কিন্তু ২০২২ সালে যুক্তরাষ্ট্র-মেক্সিকো সীমান্ত থেকে হাজার হাজার অভিবাসীকে বাসে করে শিকাগোতে পাঠানো হলে, তারা আবার সক্রিয় হয়ে ওঠেন।
সিস্টার মারফি এবং সিস্টার পার্চ প্রথমে সিয়েরা লিওন থেকে আসা এক মা ও তার পাঁচ সন্তানের আশ্রয় দিয়েছিলেন। কিন্তু দ্রুতই তারা বুঝতে পারেন, সাহায্যের প্রয়োজন আরও অনেক বেশি। এরপর তারা ১৭টি অ্যাপার্টমেন্ট ভাড়া করে সেখানে ১৭টি আশ্রয়প্রার্থী পরিবারের থাকার ব্যবস্থা করেন এবং ক্যাথরিন’স কেয়ারিং কজ নামে একটি অলাভজনক সংস্থা তৈরি করেন। এই সংস্থার মাধ্যমে তারা অভিবাসীদের জন্য আবাসন, খাদ্য এবং আইনি সহায়তা প্রদান করে আসছেন।
গত তিন বছরে তারা ২৫টি পরিবারের পাশে দাঁড়িয়েছেন। তারা এক বছরের জন্য ঘর ভাড়া এবং অন্যান্য খরচ দিয়েছেন, খাদ্য সরবরাহ করেছেন এবং আইনি সহায়তার ব্যবস্থা করেছেন। জুলেইকা নামের একজন নারী, যিনি তার স্বামী অস্কার এবং ১৪ বছর বয়সী ছেলে জোসাফাতকে নিয়ে এক বছর আগে মধ্য আমেরিকা থেকে এসেছিলেন, সম্প্রতি সিস্টারদের সঙ্গে দেখা করতে এসে তাদের প্রতি গভীর কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন। জুলেইকা ও অস্কার জানান, তাদের জীবন কতটা কঠিন ছিল এবং কিভাবে তারা জীবনের ঝুঁকি নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রে আসতে বাধ্য হয়েছিলেন।
আশ্রয় প্রার্থনাকারীদের সাহায্যের পাশাপাশি, সিস্টাররা তাদের আইনি লড়াইয়েও পাশে থাকেন। অস্কার বলেন, তারা তাদের আদালতে পর্যন্ত নিয়ে গিয়েছেন। এই সাহায্য এবং তাদের খ্রিস্টান ধর্মের প্রতি বিশ্বাসের কারণে তাদের মধ্যে গভীর সম্পর্ক গড়ে উঠেছে।
সিস্টাররা অভিবাসীদের আশ্রয় ও সহায়তা দেওয়ার পাশাপাশি তাদের অধিকার আদায়েও সোচ্চার। তারা বিভিন্ন প্রতিবাদ কর্মসূচিতে অংশ নেন এবং অভিবাসন নীতির বিরুদ্ধে সোচ্চার হন।
সিস্টার পার্চ একবার বলেছিলেন, “আমরা আমাদের পরিবারকে খারাপ পরিস্থিতির জন্য প্রস্তুত করছি, তবে আমরা ভালো কিছুর জন্য প্রার্থনা করছি।”
শিকাগোর ইমিগ্রেশন অ্যান্ড কাস্টমস এনফোর্সমেন্ট (ICE) অফিসের বাইরে সিস্টার জোআন নিয়মিত প্রার্থনা করেন। তিনি বলেন, “আমাদের সংগ্রাম চালিয়ে যেতে হবে। এই কঠিন সময়ে আমাদের সবারই প্রয়োজন।
সিস্টার পার্চ ও সিস্টার মারফি ১৯৬০-এর দশকে উইসকনসিনে একটি ক্যাথলিক স্কুল খোলার সময় একে অপরের সঙ্গে পরিচিত হন। তাদের একই রকম মূল্যবোধ ছিল এবং তারা দরিদ্র ও অসহায় মানুষের সাহায্য করতে চেয়েছিলেন। তাদের এই যাত্রা আজও অব্যাহত আছে।
সিস্টারদের এই কাজ অন্যদেরও অনুপ্রাণিত করেছে। তাদের এই কাজ ‘ভায়াটর হাউস অফ হসপিটালিটি’ এবং ‘বেথানি হাউস অফ হসপিটালিটি’-এর মতো সংস্থার জন্ম দিয়েছে, যা অভিবাসীদের জন্য শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও মানসিক স্বাস্থ্য পরিষেবা প্রদান করে।
সিস্টার মারফি ও সিস্টার পার্চ তাদের কাজের মাধ্যমে বাইবেলের ম্যাথিউ ২৫:৩৫ শ্লোকটি অনুসরণ করেন, যেখানে বলা হয়েছে, “আমি বিদেশী ছিলাম, আর তোমরা আমাকে আশ্রয় দিয়েছিলে।” তারা পোপ ফ্রান্সিসের এই বার্তা দ্বারাও অনুপ্রাণিত, যেখানে তিনি বলেছেন, অভিবাসীরা “তোমার ভাই, তুমি তাদের পাশ কাটিয়ে যেতে পারো না। তাদের প্রতি সাড়া দিতে হবে।”
সিস্টারদের এই সেবা ও ত্যাগের গল্প অভিবাসীদের প্রতি সহানুভূতি তৈরি করে এবং তাদের অধিকারের পক্ষে কথা বলতে উৎসাহিত করে। তাদের কাজ প্রমাণ করে যে, বয়স কোনো বাধা নয়, যদি থাকে মানুষের প্রতি ভালোবাসা ও সমাজের জন্য কিছু করার অদম্য ইচ্ছা।
তথ্য সূত্র: Associated Press