যুক্তরাষ্ট্র দূতাবাসগুলি থেকে বায়ুমান বিষয়ক তথ্য সরবরাহ বন্ধ করে দেওয়ায় বিশ্বজুড়ে পরিবেশ বিজ্ঞানীরা উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন। এই সিদ্ধান্তের ফলে উন্নয়নশীল দেশগুলোতে বায়ু দূষণ পর্যবেক্ষণে বড় ধরনের প্রভাব পড়ার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে।
সম্প্রতি, মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তর জানিয়েছে যে তারা তাদের দূতাবাস ও কনস্যুলেটগুলোতে বায়ু মানের উপর নজরদারি বিষয়ক কার্যক্রম থেকে সংগৃহীত তথ্য আর ‘এয়ার নাও’ (AirNow) অ্যাপসহ অন্যান্য প্ল্যাটফর্মে পাঠাবে না। এই প্ল্যাটফর্মগুলির মাধ্যমে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের মানুষ এবং বিজ্ঞানীরা সেই সব শহরের বায়ু মানের চিত্র দেখতে ও বিশ্লেষণ করতে পারতেন। খবর অনুযায়ী, এই পদক্ষেপের মূল কারণ হলো অর্থ সংকট। এর ফলে দূতাবাস ও কনস্যুলেটগুলোকে তাদের বায়ুমান পরিমাপক যন্ত্র চালু রাখতে বলা হলেও, তথ্য আদান-প্রদান সম্ভবত স্থগিত করা হয়েছে। তবে, অর্থ বরাদ্দ পুনর্বহাল হলে ভবিষ্যতে এই কার্যক্রম পুনরায় চালু হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বায়ুমান পরিমাপক যন্ত্রগুলো মূলত PM2.5 নামে পরিচিত অতি সূক্ষ্ম কণাগুলোর উপস্থিতি মাপত। এই কণাগুলো মানুষের ফুসফুসে গভীর পর্যন্ত প্রবেশ করতে পারে এবং শ্বাসকষ্ট, হৃদরোগসহ বিভিন্ন স্বাস্থ্য সমস্যার সৃষ্টি করে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (WHO) হিসাব অনুযায়ী, বায়ু দূষণের কারণে প্রতি বছর বিশ্বে প্রায় ৭০ লক্ষ মানুষের মৃত্যু হয়।
যুক্তরাষ্ট্রের এই সিদ্ধান্তকে বায়ুমান গবেষণা ও পর্যবেক্ষণের ক্ষেত্রে একটি ‘বড় ধাক্কা’ হিসেবে দেখছেন বিশেষজ্ঞরা। নয়াদিল্লিতে অবস্থিত ‘সাসটেইনেবল ফিউচার্স কোলাবোরেটিভ’-এর বায়ু দূষণ বিশেষজ্ঞ, ভার্গব কৃষ্ণ বলেন, “উন্নয়নশীল দেশগুলোতে বায়ুমান পরিমাপের জন্য হাতে গোনা কয়েকটি যন্ত্রের মধ্যে এগুলো ছিল অন্যতম। বায়ুমান কেমন, তা বুঝতে এটি একটি নির্ভরযোগ্য মাধ্যম ছিল।” তিনি আরও যোগ করেন, “স্থানীয়ভাবে সংগৃহীত তথ্যের গুণগত মান নিয়ে সন্দেহ দেখা দিলে, এই যন্ত্রগুলোর তথ্য ক্রস-চেক করার কাজেও ব্যবহার করা হতো।”
ঢাকার বায়ুমান বর্তমানে বেশ উদ্বেগজনক পর্যায়ে রয়েছে। এমন পরিস্থিতিতে, যুক্তরাষ্ট্রের এই পদক্ষেপ বাংলাদেশের জন্য একটি অশনি সংকেত। কারণ, অনেক উন্নয়নশীল দেশের মতো, বায়ুমান পর্যবেক্ষণে বাংলাদেশও আন্তর্জাতিক ডেটার উপর নির্ভরশীল। বিশেষ করে, ঢাকার মতো জনবহুল শহরগুলোতে বায়ু দূষণের মাত্রা নিয়ন্ত্রণে রাখতে নির্ভরযোগ্য তথ্য-উপাত্তের কোনো বিকল্প নেই।
পাকিস্তানের পেশোয়ারের মতো বিশ্বের অন্যতম দূষিত শহরগুলোতে এই যন্ত্রগুলি তাৎক্ষণিক তথ্য সরবরাহ করত, যা নীতিনির্ধারক, গবেষক এবং সাধারণ মানুষকে স্বাস্থ্য বিষয়ক সিদ্ধান্ত নিতে সাহায্য করত। পরিবেশ বিষয়ক বিশেষজ্ঞ খালিদ খান মনে করেন, “বায়ুমান পর্যবেক্ষণের এই কার্যক্রম বন্ধ হয়ে যাওয়ায় পরিবেশগত নজরদারিতে একটি বড় শূন্যতা তৈরি হবে, যার ফলে সেখানকার বাসিন্দারা ঝুঁকিপূর্ণ বায়ু পরিস্থিতি সম্পর্কে সঠিক তথ্য থেকে বঞ্চিত হবেন।”
যদিও কিছু দেশে নিজস্ব বায়ুমান পরিমাপ ব্যবস্থা গড়ে তোলার চেষ্টা চলছে, তবে অনেক দেশ এখনো যুক্তরাষ্ট্রের ডেটার উপর নির্ভরশীল। বিশেষ করে আফ্রিকার কয়েকটি দেশ, যেমন- সেনেগাল, নাইজেরিয়া, চাদ ও মাদাগাস্কারের মতো দেশগুলো তাদের বায়ুমান বিষয়ক তথ্যের জন্য কার্যত এই সিস্টেমের উপর নির্ভরশীল ছিল।
যুক্তরাষ্ট্রের এই পদক্ষেপ বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার বায়ুমান ডেটাবেসকেও প্রভাবিত করবে। কারণ অনেক দরিদ্র দেশে বায়ুমান পরিমাপ কেন্দ্র স্থাপন ও পরিচালনা করা ব্যয়বহুল ও জটিল। ফলে, তারা যুক্তরাষ্ট্রের দূতাবাসগুলোর দেওয়া তথ্যের উপর নির্ভরশীল থাকে।
তবে, কোনো কোনো ক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্রের বায়ুমান পরিমাপ কেন্দ্রগুলি স্থানীয় পর্যায়ে বায়ুমান বিষয়ক গবেষণা বাড়াতে এবং সচেতনতা সৃষ্টি করতে সহায়তা করেছে। উদাহরণস্বরূপ, চীনের বেইজিংয়ে অবস্থিত মার্কিন দূতাবাস থেকে পাওয়া তথ্য দেশটির সরকারি প্রতিবেদনের সঙ্গে মিলছিল না, যা কর্তৃপক্ষের প্রকাশিত দূষণের মাত্রা থেকে বেশি ছিল। এর ফলস্বরূপ, চীন সরকার বায়ুমান উন্নয়নের দিকে মনোযোগ দিতে বাধ্য হয়।
ভারতে বায়ুমান পর্যবেক্ষণ বন্ধ হয়ে যাওয়াকে ‘বড় ধাক্কা’ হিসেবে উল্লেখ করে ‘গ্লোবাল ক্লাইমেট অ্যান্ড হেলথ অ্যালায়েন্স’-এর প্রচার বিভাগের প্রধান শ্বেতা নারায়ণ বলেন, “এই পরিস্থিতি ভারতের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ সুযোগ তৈরি করেছে। নিজেদের বায়ুমান পর্যবেক্ষণের অবকাঠামো শক্তিশালী করে, তথ্যের স্বচ্ছতা নিশ্চিত করে এবং বায়ুমান বিষয়ক প্রতিবেদনে জনগণের আস্থা তৈরি করে ভারত পরিবেশগত ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে একটি দৃষ্টান্ত স্থাপন করতে পারে।”
তথ্য সূত্র: এসোসিয়েটেড প্রেস