সিরিয়ায় বাশার আল-আসাদ সরকারের পতনের পর এবার সবচেয়ে ভয়াবহ সংঘর্ষের ঘটনা ঘটেছে। নিরাপত্তা বাহিনী ও সাবেক প্রেসিডেন্ট বাশার আল-আসাদের অনুসারীদের মধ্যে এই সংঘর্ষে কয়েকশ মানুষ নিহত হয়েছে।
ভূমধ্যসাগরের উপকূলীয় এলাকা লাটাকিয়া ও তারতুসে বৃহস্পতিবার (বর্তমান সপ্তাহের) এই সংঘর্ষ শুরু হয়। এই অঞ্চলগুলোতে সিরিয়ার আলাউয়েট সম্প্রদায়ের মধ্যে আসাদের সমর্থন ছিল, এবং গত তিন মাস ধরে এখানে সাম্প্রদায়িক সহিংসতার ঘটনা ঘটেছে।
শুক্রবার (বর্তমান সপ্তাহের) সিরিয়ান নেটওয়ার্ক ফর হিউম্যান রাইটস (এসএনএইচআর) জানিয়েছে, বৃহস্পতিবার থেকে সংঘর্ষে মৃতের সংখ্যা ২২৫ জনের বেশি। এসএনএইচআর আরও জানায় নিহতদের মধ্যে ১২৫ জন বেসামরিক নাগরিক। তাদের অভিযোগ, সরকারি বাহিনী তরুণ এবং বয়স্ক পুরুষদের নির্বিচারে হত্যা করেছে।
তবে, এসএনএইচআর-এর এই তথ্যের সত্যতা যাচাই করতে পারেনি সিএনএন। মৃতের সংখ্যা সম্পর্কে জানতে সিরীয় সরকারের সঙ্গে যোগাযোগ করা হচ্ছে।
সিরীয় সরকার জানিয়েছে, তারা এই সহিংসতার ঘটনা পর্যবেক্ষণ করার জন্য একটি ‘জরুরি কমিটি’ গঠন করেছে। সরকারি বাহিনীর কেউ যদি নিয়ম ভেঙে থাকে, তবে তাদের সামরিক আদালতে পাঠানো হবে।
সিরিয়ার একটি নিরাপত্তা সূত্র শুক্রবার রাষ্ট্রীয় বার্তা সংস্থা সানাকে জানায়, ‘অসংগঠিত জনতা’ ওই এলাকায় যাওয়ার পরই কিছু ‘ব্যক্তিগত সহিংসতা’ সংঘটিত হয়েছে।
সিরীয় সরকার সিএনএন-কে জানিয়েছে, বৃহস্পতিবার থেকে তাদের অন্তত ১৫০ জন নিরাপত্তা কর্মী নিহত এবং ৩০০ জনকে বন্দী করা হয়েছে।
আলাউয়েট সম্প্রদায়ের লোক ছিলেন বাশার আল-আসাদ। আসাদ পরিবার এক শতাব্দীরও বেশি সময় ধরে সিরিয়া শাসন করেছে। গত বছর সুন্নি ইসলামপন্থী জঙ্গিরা ক্ষমতাচ্যুত করার পরে সিরিয়ার রাজনৈতিক ও সাম্প্রদায়িক কাঠামো পরিবর্তনের চেষ্টা করে।
সিরিয়ার জনসংখ্যার প্রায় ১০ শতাংশ আলাউয়েট সম্প্রদায়ের মানুষ। আসাদ সরকারের আমলে তাদের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল। ডিসেম্বর মাস থেকে অনেক আলাউয়েত তাদের অস্ত্র সমর্পণ করেছে, তবে অনেকেই এখনো অস্ত্র হাতে রেখেছে।
নতুন সরকারের জন্য এই সহিংসতা একটি বড় চ্যালেঞ্জ। বিশেষ করে যারা এখনো সশস্ত্র অবস্থায় রয়েছে, তাদের শান্ত করা কঠিন হয়ে পড়েছে।
শুক্রবার এক টেলিভিশন ভাষণে সিরিয়ার অন্তর্বর্তীকালীন প্রেসিডেন্ট আহমদ আল-শারা নিহত নিরাপত্তা কর্মীদের হত্যার সঙ্গে জড়িতদের খুঁজে বের করার অঙ্গীকার করেছেন। সংঘর্ষের সময় বেসামরিক হতাহতের ঘটনা ঘটেছে উল্লেখ করে তিনি নিরাপত্তা বাহিনীকে ‘কোনো ধরনের বাড়াবাড়ি বা অযৌক্তিক পদক্ষেপ’ না নেওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন।
সরকারী সংবাদ সংস্থা সানা জানিয়েছে, কয়েকজন পুলিশ ও নিরাপত্তা কর্মীর মৃত্যুর পর ‘অসংগঠিত জনতা উপকূলের দিকে অগ্রসর হয়’। সিরিয়ার স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের একজন কর্মকর্তার বরাত দিয়ে এই তথ্য জানানো হয়েছে।
সিরিয়ার গোয়েন্দা প্রধান আনাস খাত্তাব বলেছেন, ‘সাবেক সামরিক ও নিরাপত্তা নেতারা এই অপরাধের পরিকল্পনা ও বাস্তবায়নের সঙ্গে জড়িত’। তিনি আরও বলেন, ‘এই বিশ্বাসঘাতকতার কারণে সেনাবাহিনী, নিরাপত্তা ও পুলিশের অনেক সদস্য নিহত হয়েছেন’।
বৃহস্পতিবার থেকে সামাজিক মাধ্যমে প্রকাশিত ভিডিওগুলোতে সিরিয়ার নিরাপত্তা বাহিনী এবং বেসামরিক পোশাকে থাকা তরুণদের ব্যাপক হতাহতের চিত্র দেখা গেছে।
একটি ভিডিওতে দেখা যায়, একটি পুলিশ গাড়ির পাশে কয়েকজন লোক মৃত অবস্থায় পড়ে আছে। সিএনএন কর্তৃক যাচাইকৃত অন্য একটি ভিডিওতে দেখা যায়, আল-জিনদেরিয়া শহরের কাছে একটি গ্রামে অন্তত ২০ জন বেসামরিক পোশাকে থাকা পুরুষকে গুলি করে হত্যা করা হয়েছে। এছাড়া, নিরাপত্তা বাহিনীকে রাতের অন্ধকারে তীব্রভাবে গুলি চালাতে দেখা গেছে।
শুক্রবার প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র কর্নেল হাসান আবদেল ঘানি বলেছেন, ‘শীর্ষ যুদ্ধাপরাধীরা পাহাড়ে পালিয়ে রয়েছে, তাদের বিচার নিশ্চিত’। তিনি আসাদ সমর্থকদের প্রতি অস্ত্র সমর্পণের আহ্বান জানিয়ে বলেন, ‘যুদ্ধ চালিয়ে যাওয়ার কোনো মানে নেই… অস্ত্র জমা দিন, না হয় নিজেদের পরিণতির জন্য প্রস্তুত থাকুন’।
শুক্রবার সামাজিক মাধ্যমে আসা অন্যান্য ফুটেজে দেখা গেছে, ওই এলাকায় প্রচুর সামরিক বাহিনীর আনাগোনা বাড়ছে। তারতুস শহরে শনিবার পর্যন্ত কারফিউ জারি করা হয়েছে।
ভিডিওগুলোতে দেখা যায়, নিরাপত্তা বাহিনী রুশ বিমানঘাঁটির কাছে অবস্থিত জাবলেহ শহরে পৌঁছেছে, এবং সেখানে সংঘর্ষ ও ধোঁয়ার কলাম উড়তে দেখা গেছে।
অন্যান্য ভিডিওতে সরকারি বাহিনীকে আসাদ পরিবারের আদি শহর আল-কারদাহে বিস্ফোরণ ও ধোঁয়ার কলামের মধ্যে প্রবেশ করতে দেখা গেছে। প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের একজন কর্মকর্তা পরে নিশ্চিত করেছেন যে, নিরাপত্তা বাহিনী আল-কারদাহে ‘সাবেক সরকারের অবশিষ্টদের বিরুদ্ধে’ অভিযান চালিয়েছে। সানা এই খবর জানায়। জাবলেহর কাছে উপকূলের একটি ভিডিওতে সামরিক হেলিকপ্টার থেকে বোমা ফেলতে দেখা গেছে।
শুক্রবার সিরিয়ার স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এক বিবৃতিতে ‘সকল বেসামরিক নাগরিকদের সামরিক ও নিরাপত্তা অভিযান এলাকা থেকে দূরে থাকার’ আহ্বান জানিয়েছে। এতে আরও বলা হয়েছে, সকল সামরিক ও নিরাপত্তা ইউনিটকে ‘বেসামরিক নাগরিকদের সুরক্ষার জন্য প্রতিষ্ঠিত নিয়ম ও আইন কঠোরভাবে মেনে চলতে’ নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।
সিরিয়ার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, বৃহস্পতিবার রাতে লাটাকিয়া ও তারতুসের গ্রামীণ এলাকার ছয়টি হাসপাতালে আসাদ অনুসারীরা হামলা চালিয়েছে, এতে বেশ কয়েকজন নিহত হয়েছে।
লাটাকিয়ায় অবস্থিত কর্মী ও সাংবাদিক আব্দুল রহমান তালেব জানান, বৃহস্পতিবার সিরিয়ার নিরাপত্তা বাহিনীর সঙ্গে সংঘর্ষের খবর সংগ্রহ করার সময় আসাদ অনুসারীরা তার ওপর হামলা করে।
তালেব বলেন, ‘আমরা লাটাকিয়ার একটি এলাকায় প্রায় ১২ ঘণ্টা অবরুদ্ধ ছিলাম। চারিদিকে মিলিট্যান্টদের আনাগোনা ছিল। আমি ভাবিনি যে আমরা জীবিত ফিরতে পারব’। তিনি আরও জানান, এলাকার অন্য আলাউয়েত সম্প্রদায়ের লোকজন তাকে আশ্রয় দিয়েছিলেন, ‘প্রথম সাহায্য আসার পর তারা আমাদের উদ্ধার করে’।
এই সহিংসতার জেরে সিরিয়ার কয়েকটি শহরে সরকারপন্থী ও বিরোধী বিক্ষোভ হয়েছে।
নতুন সরকারের জোরালো সমর্থক সৌদি আরব সিরিয়ায় ‘আইন বহির্ভূত গোষ্ঠীগুলোর দ্বারা সংঘটিত অপরাধের’ নিন্দা করেছে।
তথ্য সূত্র: সিএনএন