জীবনে শোক আর হতাশার সঙ্গে লড়াই করা কারো জন্য সহজ নয়। কারো আপনজনের মৃত্যু, বিশেষ করে মায়ের মৃত্যু, আমাদের অস্তিত্বের উপর গভীর প্রভাব ফেলে। এই শোক কাটিয়ে ওঠা কঠিন হলেও অসম্ভব নয়। প্রয়োজন সঠিক সময়ে সঠিক পদক্ষেপ নেওয়া। আর এই লড়াইয়ে একজন মানুষের পাশে এসে দাঁড়াতে পারে মনোবৈজ্ঞানিক পরামর্শ (psychological counseling)।
আজকের গল্পটি এমনই এক ব্যক্তির, যিনি মায়ের মৃত্যুর পর গভীর শোক ও হতাশায় নিমজ্জিত হয়েছিলেন। তিনি বুঝতে পারছিলেন, একা এই অবস্থা থেকে বের হওয়া সম্ভব নয়। তাই তিনি মনোচিকিৎসকের শরণাপন্ন হন। তাঁর সেই অভিজ্ঞতাই আজ আমরা জানবো।
ছেলেবেলা থেকেই ওই ব্যক্তির মা ছিলেন কঠিন রোগে আক্রান্ত। যখন তাঁর বয়স ১৫ বছর, তখন মায়ের ক্যান্সার ধরা পড়ে। চিকিৎসকেরা জানিয়েছিলেন, ৬ মাসের বেশি হয়তো তিনি বাঁচবেন না। কিন্তু মা লড়ে গিয়েছিলেন, আরও ৪ বছর পর্যন্ত। মায়ের এই অসুস্থতা এবং অবশেষে তাঁর মৃত্যু, ওই ব্যক্তির জীবনে গভীর ক্ষত সৃষ্টি করে।
শুরুতে, তিনি কয়েকজন থেরাপিস্টের সঙ্গে দেখা করেছিলেন। তাদের পরামর্শ নিতেন, কিন্তু খুব বেশিদিন সেই প্রক্রিয়া চলেনি। তিনি যেন এক ধরনের পরীক্ষার মধ্য দিয়ে যাচ্ছিলেন। কেউ তাঁকে কগনিটিভ বিহেভিয়োরাল থেরাপি (Cognitive Behavioral Therapy) নিতে বলেছিলেন, আবার কেউ বলেছিলেন মননশীলতা (Mindfulness) চর্চা করতে। তিনি তাঁদের পরামর্শগুলো মেনে চলতেন, যেনতেন প্রকারে পরিস্থিতি সামাল দিতে চাইতেন। কিন্তু কিছুদিনের মধ্যেই তাঁর মনে হতো, এই কৌশলগুলো তাঁর জন্য যথেষ্ট নয়।
এরপর, যখন তাঁর বয়স ২৩ বছর, তখন জীবনের কঠিন বাস্তবতার মুখোমুখি হন তিনি। বেকারত্ব, বাবার সঙ্গে বসবাস, মায়ের অভাব—সবকিছু যেন তাঁকে ঘিরে ধরেছিল। সম্পর্কগুলোও টিকছিল না, আর ভবিষ্যৎ নিয়ে তিনি ছিলেন হতাশ। তিনি বুঝতে পারছিলেন, তাঁর মানসিক স্বাস্থ্যের অবনতি হচ্ছে।
তখন তিনি আবার থেরাপির আশ্রয় নেওয়ার কথা ভাবেন। কিন্তু সরকারি স্বাস্থ্যসেবা কেন্দ্রে দীর্ঘ অপেক্ষার কারণে এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের বিনামূল্যে থেরাপি পরিষেবা বন্ধ হয়ে যাওয়ায়, তিনি বেসরকারি থেরাপিস্টের কাছে যাওয়া শুরু করেন। প্রথম দিকে কিছু অভিজ্ঞতা ভালো ছিল না। একবার তো একজন থেরাপিস্ট চুপ করে তাঁর কথা শুনেছিলেন, আর এর জন্য তিনি বেশ মোটা অঙ্কের ফি দিতে বাধ্য হয়েছিলেন।
অবশেষে, তিনি একজন থেরাপিস্ট খুঁজে পান, যিনি তাঁর মতোই এশীয় বংশোদ্ভূত ছিলেন এবং তাঁর ভালো শিক্ষা ও অভিজ্ঞতা ছিল। এই থেরাপিস্টের সঙ্গে তাঁর আলোচনাগুলো ছিল ভিন্ন ধরনের। প্রথম সেশনে তিনি তাঁর দিনটি কেমন কাটছে, সে বিষয়ে কথা বলেন। এই ধরনের আলোচনা তাঁকে হালকা অনুভব করতে সাহায্য করত। ধীরে ধীরে তিনি তাঁর মায়ের কথা, নিজের জীবন ও ভবিষ্যতের স্বপ্ন নিয়ে কথা বলতে শুরু করেন। থেরাপিস্ট তাঁকে জীবনের চাপ ও প্রত্যাশাগুলো বুঝতে সাহায্য করেন।
সপ্তাহ, মাস পেরিয়ে বছর গড়ানোর সঙ্গে সঙ্গে, তাঁর মধ্যে পরিবর্তন আসা শুরু হয়। থেরাপির মাধ্যমে তিনি নিজের অনুভূতিগুলোর সঙ্গে পরিচিত হতে শুরু করেন। তিনি বুঝতে পারেন, সম্পর্কের ক্ষেত্রে দুর্বলতা প্রকাশ করতে না পারার কারণে সমস্যা হচ্ছিল। হতাশার কারণ ছিল, কঠিন অনুভূতিগুলো থেকে নিজেকে দূরে রাখা।
এই থেরাপিস্টের সঙ্গে তিনি গত সাত বছর ধরে নিয়মিতভাবে কথা বলছেন। এই দীর্ঘমেয়াদী থেরাপি তাঁর জীবনে গভীর পরিবর্তন এনেছে। মায়ের মৃত্যু আজও তাঁর কাছে কষ্টের, কিন্তু এখন তিনি ভবিষ্যৎ নিয়ে অনেক বেশি আশাবাদী। তিনি জানেন, হয়তো একদিন থেরাপি বন্ধ করে দেবেন, কিন্তু তার পরেও তিনি জীবনকে ভালোবাসতে এবং ভালোভাবে বাঁচতে চান।
আমাদের সমাজে মানসিক স্বাস্থ্য নিয়ে আলোচনা করতে অনেকেই দ্বিধা বোধ করেন। অনেকে মনে করেন, মানসিক সমস্যা দুর্বলতার লক্ষণ। কিন্তু বাস্তবতা হলো, মানসিক স্বাস্থ্য শারীরিক স্বাস্থ্যের মতোই গুরুত্বপূর্ণ। প্রয়োজন হলে, একজন বিশেষজ্ঞের সাহায্য নিতে দ্বিধা করা উচিত নয়। এটি দুর্বলতা নয়, বরং নিজের প্রতি যত্নশীল হওয়ার একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ।
তথ্য সূত্র: The Guardian