শনির চারদিকে আরও ১২৮ টি নতুন উপগ্রহ আবিষ্কার করেছেন বিজ্ঞানীরা, যা সৌরজগতের এই গ্রহটিকে উপগ্রহের সংখ্যায় একচ্ছত্র আধিপত্য এনে দিয়েছে। এখন শনির মোট উপগ্রহের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ২৭৪। এই সংখ্যাটি সৌরজগতের অন্য সব গ্রহের মিলিত উপগ্রহ সংখ্যার প্রায় দ্বিগুণ।
আগে সৌরজগতের ‘উপগ্রহরাজা’ হিসেবে পরিচিত ছিল বৃহস্পতি। কিন্তু নতুন আবিষ্কারের ফলে সেই স্থান দখল করেছে শনি। তাই জ্যোতির্বিজ্ঞানীরা বলছেন, এখন শনিকে ডিঙিয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা নেই বললেই চলে।
তাইওয়ানের অ্যাকাডেমিয়া সিনিকা’র (Academia Sinica) ইনস্টিটিউট ফর অ্যাস্ট্রোনমি অ্যান্ড অ্যাস্ট্রোফিজিক্সের (Institute for Astronomy and Astrophysics) একদল গবেষক এই নতুন আবিষ্কার করেছেন। গবেষণা দলের প্রধান ড. এডওয়ার্ড অ্যাশটন জানিয়েছেন, তারা কানাডা-ফ্রান্স-হায়াই টেলিস্কোপ ব্যবহার করে এর আগে শনির ৬২টি উপগ্রহ চিহ্নিত করেছিলেন। এরপর আরও কিছু উপগ্রহের অস্তিত্বের প্রমাণ পাওয়ার পর ২০২৩ সালে তারা নতুন করে পর্যবেক্ষণ চালান। সেই পর্যবেক্ষণে অতিরিক্ত আরও ১২৮টি উপগ্রহ খুঁজে পাওয়া যায়।
আন্তর্জাতিক জ্যোতির্বিজ্ঞান ইউনিয়ন (International Astronomical Union) আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি দেওয়ার পর, উপগ্রহগুলোর নামকরণ করা হবে। শনির উপগ্রহগুলোর নামকরণের রীতি অনুযায়ী, এগুলোর নামকরণ করা হবে গ্যালিক, নরস এবং কানাডীয় ইনুইট দেব-দেবীর নামানুসারে। নতুন আবিষ্কৃত উপগ্রহগুলোর অধিকাংশই নরস ক্লাস্টারের অন্তর্ভুক্ত।
‘শিফট অ্যান্ড স্ট্যাক’ (Shift and Stack) নামের একটি বিশেষ কৌশল ব্যবহার করে উপগ্রহগুলো চিহ্নিত করা হয়েছে। এই পদ্ধতিতে, বিজ্ঞানীরা আকাশে উপগ্রহগুলোর গতিপথ অনুসরণ করে ধারাবাহিক ছবি তোলেন এবং সেগুলোকে একত্রিত করে উপগ্রহটিকে দৃশ্যমান করেন। নতুন পাওয়া ১২৮টি উপগ্রহই অনিয়মিত আকারের। এগুলোর আকার আলু বা ডিমের মতো এবং ব্যাস কয়েক কিলোমিটারের বেশি নয়।
ড. অ্যাশটন আরও বলেন, “উপগ্রহ হিসেবে আসলে কিসের সংজ্ঞা দেওয়া হবে, সে বিষয়ে সম্ভবত এখনো পর্যন্ত কোনো সুস্পষ্ট ধারণা নেই। সম্ভবত সেই সংজ্ঞা নির্ধারণ করা দরকার।” তবে তিনি এও মনে করেন যে, বর্তমান প্রযুক্তি ব্যবহার করে শনি, ইউরেনাস ও নেপচুনের উপগ্রহ সম্পর্কে এর চেয়ে বেশি কিছু আবিষ্কার করা কঠিন।
ছোট আকারের এই উপগ্রহগুলো পর্যবেক্ষণ করে বিজ্ঞানীরা সৌরজগতের প্রাথমিক সময়ের অস্থিরতা সম্পর্কে জানতে পারবেন। কারণ, গ্রহগুলো যখন অস্থির কক্ষপথে ঘুরছিল এবং সংঘর্ষ খুবই সাধারণ ঘটনা ছিল, সেই সময়ের অনেক তথ্য লুকিয়ে আছে এই উপগ্রহগুলোতে। নতুন উপগ্রহগুলো দলবদ্ধভাবে অবস্থান করছে, যা ইঙ্গিত করে যে এদের অধিকাংশই একসময়কার বড় আকারের বস্তুর ধ্বংসাবশেষ। ধারণা করা হয়, গত ১০০ মিলিয়ন বছরের মধ্যে কোনো সংঘর্ষের ফলে এই বস্তুগুলো ভেঙে গিয়েছিল। উপগ্রহগুলো শনির কাছাকাছি থাকা উপগ্রহগুলোর তুলনায় বড় এবং উপবৃত্তাকার কক্ষপথে ঘোরে।
ইউনিভার্সিটি অব ব্রিটিশ কলাম্বিয়ার (University of British Columbia) জ্যোতির্বিজ্ঞানী অধ্যাপক ব্র্রেট গ্লাডম্যানের মতে, “এগুলো সম্ভবত শনির মাধ্যাকর্ষণে আকৃষ্ট হওয়া আদি উপগ্রহের টুকরো, যেগুলো অন্য শনির উপগ্রহ অথবা ধূমকেতুর সঙ্গে সংঘর্ষের কারণে ভেঙে গিয়েছিল।” শনির এতগুলো উপগ্রহের গতিপ্রকৃতি বিশ্লেষণ করে বিজ্ঞানীরা শনির বলয় কীভাবে তৈরি হয়েছে, সে সম্পর্কেও ধারণা পেতে পারেন। কারণ, বিজ্ঞানীদের ধারণা, শনির একটি উপগ্রহ ভেঙে যাওয়ার ফলেই এই বলয় তৈরি হয়েছে।
অন্যদিকে, ইউরোপীয় মহাকাশ সংস্থা (European Space Agency) ‘হেরা’ (Hera) নামের একটি মহাকাশযান আগামী বুধবার মঙ্গলের পাশ দিয়ে যাবে এবং এর ক্ষুদ্রতম ও দূরবর্তী উপগ্রহ ডিমোসের (Deimos) ৩০০ কিলোমিটার (১৯০ মাইল) কাছ দিয়ে যাবে। ডিমোসের ব্যাস প্রায় ৭ মাইল। ধারণা করা হয়, এটি মঙ্গলের সঙ্গে কোনো বড় সংঘর্ষের ফল অথবা লাল গ্রহটির কক্ষপথে ধরা পড়া একটি গ্রহাণু। ‘হেরা’ মঙ্গলগ্রহের বৃহত্তম উপগ্রহ ফোবোসেরও ছবি তুলবে। এরপর এটি একটি গ্রহাণু, ডাইমোরফোস (Dimorphos) পর্যবেক্ষণের জন্য যাত্রা করবে। নাসা (NASA)-র একটি নভোযান তিন বছর আগে ইচ্ছাকৃতভাবে ডাইমোরফোস-এ আঘাত হানে।
গ্রহাণুটির কাছে পৌঁছে ‘হেরা’ আঘাতের পরবর্তী বিস্তারিত সমীক্ষা চালাবে। এর উদ্দেশ্য হলো, ভবিষ্যতে পৃথিবীর সঙ্গে সংঘর্ষে আসতে পারে এমন বিপজ্জনক গ্রহাণুগুলিকে সরিয়ে দেওয়ার জন্য প্রযুক্তি তৈরি করা।
তথ্য সূত্র: দ্য গার্ডিয়ান