অস্ট্রেলিয়ার এক জন রোগীর শরীরে সম্পূর্ণ কৃত্রিম হৃদযন্ত্র বসানোর পর, তিনি ১০০ দিনের বেশি সময় ধরে স্বাভাবিক জীবন যাপন করেছেন। চিকিৎসা বিজ্ঞানের ইতিহাসে এটি এক উল্লেখযোগ্য ঘটনা, যা হৃদরোগের চিকিৎসায় নতুন দিগন্তের সূচনা করেছে। সম্প্রতি, ওই ব্যক্তি সফলভাবে হৃদযন্ত্র প্রতিস্থাপনও করিয়েছেন। চিকিৎসকরা জানিয়েছেন, এটি ছিল একটি ‘অবিস্মরণীয় ক্লিনিক্যাল সাফল্য’।
বিভাসর (BiVACOR) নামক এই কৃত্রিম হৃদযন্ত্রটি তৈরি করেছেন কুইন্সল্যান্ডের ড. ড্যানিয়েল টিমস। এটি বিশ্বের প্রথম ইমপ্ল্যান্টেবল (শরীরে স্থাপনযোগ্য) রোটারি ব্লাড পাম্প, যা চুম্বকীয় প্রযুক্তির মাধ্যমে হৃদযন্ত্রের স্বাভাবিক রক্তপ্রবাহকে প্রতিস্থাপন করতে সক্ষম। হৃদযন্ত্র বিকল হয়ে যাওয়া রোগীদের জন্য এটি একটি সম্পূর্ণ বিকল্প ব্যবস্থা হিসেবে কাজ করতে পারে। সাধারণত, হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে অথবা অন্য কোনো কারণে হৃদযন্ত্র দুর্বল হয়ে গেলে এই ধরনের কৃত্রিম হৃদযন্ত্র প্রতিস্থাপনের প্রয়োজন হয়।
বিশ্বজুড়ে প্রতি বছর ২ কোটির বেশি মানুষ হৃদরোগে আক্রান্ত হন, তবে হৃদযন্ত্র প্রতিস্থাপন করার সুযোগ পান মাত্র ৬ হাজার জন। অস্ট্রেলিয়ান সরকার এই বিভাসর যন্ত্রের গবেষণা ও উন্নয়নে প্রায় ৫০ মিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ করেছে। মূলত, হৃদযন্ত্র প্রতিস্থাপনের জন্য অপেক্ষারত রোগীদের বাঁচিয়ে রাখাই এই যন্ত্রের প্রধান উদ্দেশ্য। তবে বিভাসরের নির্মাতাদের দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা হল, ভবিষ্যতে রোগীদের হৃদযন্ত্র প্রতিস্থাপনের প্রয়োজন ছাড়াই যেন এই যন্ত্রের মাধ্যমেই স্বাভাবিক জীবন যাপন করা সম্ভব হয়।
এই রোগী, যিনি নিউ সাউথ ওয়েলসের বাসিন্দা এবং ৪০-এর কোঠায় বয়স, গুরুতর হৃদযন্ত্রের সমস্যায় ভুগছিলেন। তিনি অস্ট্রেলিয়ায় প্রথম এবং বিশ্বে ষষ্ঠ ব্যক্তি হিসেবে এই কৃত্রিম হৃদযন্ত্র গ্রহণ করেন। এর আগে, গত বছর আমেরিকাতে এই ধরনের পাঁচটি অস্ত্রোপচার করা হয়েছিল, যেখানে রোগীরা হৃদযন্ত্র প্রতিস্থাপনের আগে সর্বোচ্চ ২৭ দিন পর্যন্ত এই যন্ত্রের সাহায্য নিয়েছিলেন।
গত ২২শে নভেম্বর, সিডনির সেন্ট ভিনসেন্ট হাসপাতালে ৬ ঘণ্টার একটি অস্ত্রোপচার শেষে ওই রোগীর শরীরে এই কৃত্রিম হৃদযন্ত্র স্থাপন করা হয়। অস্ত্রোপচারটি পরিচালনা করেন কার্ডিওথোরাসিক ও ট্রান্সপ্ল্যান্ট সার্জন ড. পল জানজ। অস্ত্রোপচারের পর রোগী ফেব্রুয়ারি মাসে হাসপাতাল থেকে ছাড়া পান এবং মার্চ মাসে তার হৃদযন্ত্র প্রতিস্থাপন করা হয়।
ড. জানজ এই ঐতিহাসিক সাফল্যের অংশ হতে পেরে গর্বিত। তিনি বলেন, “আমরা দীর্ঘদিন ধরে এই মুহূর্তটির জন্য অপেক্ষা করছিলাম এবং অস্ট্রেলিয়ার প্রথম দল হিসেবে এই অস্ত্রোপচার করতে পেরে আমরা অত্যন্ত আনন্দিত।” সেন্ট ভিনসেন্ট হাসপাতালের হৃদরোগ বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ক্রিস হেইওয়ার্ড মনে করেন, বিভাসর হৃদযন্ত্র হৃদরোগ চিকিৎসার ক্ষেত্রে আন্তর্জাতিকভাবে পরিবর্তন আনবে। তিনি আরও যোগ করেন, “আসন্ন দশকে আমরা দেখব, যারা হৃদযন্ত্রের জন্য অপেক্ষা করতে পারছেন না অথবা যাদের জন্য হৃদযন্ত্র পাওয়া কঠিন, তাদের জন্য এই কৃত্রিম হৃদযন্ত্র একটি নির্ভরযোগ্য বিকল্প হয়ে উঠবে।
কুইন্সল্যান্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ডেভিড কলহুন, যিনি এই গবেষণার সঙ্গে সরাসরি যুক্ত ছিলেন না, তবে হৃদরোগ ফাউন্ডেশনের একজন বোর্ড সদস্য, এই সাফল্যকে কৃত্রিম হৃদযন্ত্রের ক্ষেত্রে “প্রযুক্তিগত এক বিশাল পদক্ষেপ” হিসেবে বর্ণনা করেছেন। যদিও তিনি সতর্ক করে বলেন, কৃত্রিম হৃদযন্ত্রের কার্যকারিতা (১০০ দিনের বেশি) এখনো স্বাভাবিক হৃদযন্ত্রের (১০ বছরের বেশি) তুলনায় অনেক কম। তাই হৃদযন্ত্র প্রতিস্থাপনের বিকল্প হিসেবে এটিকে সম্পূর্ণভাবে বিবেচনা করতে এখনো অনেক পথ বাকি।
তবে, উন্নত চিকিৎসা ব্যবস্থার কারণে হৃদরোগে আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা আগের তুলনায় অনেক কমেছে। উদাহরণস্বরূপ, ১৯৬৭-৬৮ সালে অস্ট্রেলিয়ায় হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে মারা যাওয়া মানুষের সংখ্যা ছিল ৪৭ হাজার, যেখানে সে দেশের জনসংখ্যা ছিল মাত্র ১ কোটি ১০ লক্ষ। যেখানে ২০২২ সালে, এই সংখ্যাটি ছিল ৪৫ হাজার, যদিও সে সময় জনসংখ্যা ছিল ২ কোটি ৬০ লক্ষ।
অস্ট্রেলিয়ার মোনাশ ইউনিভার্সিটির নেতৃত্বে পরিচালিত ‘আর্টিফিশিয়াল হার্ট ফ্রন্টিয়ার্স প্রোগ্রাম’-এর অংশ হিসেবে এই ধরনের আরও অস্ত্রোপচার করার পরিকল্পনা রয়েছে। এই প্রকল্পের অধীনে হৃদরোগের সাধারণ সমস্যাগুলো সমাধানের জন্য তিনটি গুরুত্বপূর্ণ যন্ত্র তৈরি করা হচ্ছে।
তথ্য সূত্র: দ্য গার্ডিয়ান