যুদ্ধবিধ্বস্ত ইউক্রেনে শান্তি ফেরানোর লক্ষ্যে যুক্তরাষ্ট্র এবং ইউক্রেনের মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ আলোচনা হয়েছে।
সৌদি আরবে অনুষ্ঠিত এই বৈঠকে ইউক্রেন ৩০ দিনের যুদ্ধবিরতি প্রস্তাবে রাজি হয়েছে।
আলোচনার ফলস্বরূপ, যুক্তরাষ্ট্র কিয়েভকে সামরিক সহায়তা এবং গোয়েন্দা তথ্য সরবরাহের ওপর থেকে নিষেধাজ্ঞা তুলে নিয়েছে।
সৌদি আরবের জেদ্দায় আট ঘণ্টা ধরে আলোচনার পর উভয়পক্ষ শান্তি চুক্তিতে স্বাক্ষর করে।
যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষ থেকে এই আলোচনায় নেতৃত্ব দেন দেশটির পররাষ্ট্রমন্ত্রী মার্কো রুবিও।
তিনি জানান, এখন সব দায় রাশিয়ার ওপর।
এই চুক্তির প্রেক্ষাপট নিয়ে বিস্তারিত জানা যাক।
এই শান্তি আলোচনায় ইউক্রেনের প্রতিনিধি হিসেবে ছিলেন প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কির অফিসের প্রধান আন্দ্রি ইয়ারমাক, পররাষ্ট্রমন্ত্রী আন্দ্রি সিবিহা, প্রতিরক্ষামন্ত্রী রুস্তেম উমেরভ এবং জেলেনস্কি অফিসের কর্নেল পাভলো পালিসা।
অন্যদিকে, যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিনিধি হিসেবে ছিলেন মার্কো রুবিও এবং জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা মাইক ওয়াল্টজ।
আলোচনার পর যুক্তরাষ্ট্র ও ইউক্রেন একটি যৌথ বিবৃতি প্রকাশ করে।
এতে বলা হয়, দেশ দুটি ‘অবিলম্বে ৩০ দিনের জন্য একটি অন্তর্বর্তী যুদ্ধবিরতি’ তে সম্মত হয়েছে।
উভয়পক্ষের সম্মতিতে এই যুদ্ধবিরতি বাড়ানো যেতে পারে।
যুদ্ধবিরতি চুক্তির বিষয়ে জেলেনস্কি এক্সে (সাবেক টুইটার) দেওয়া পোস্টে জানান, এটি ক্ষেপণাস্ত্র, ড্রোন এবং বোমা হামলা থেকে সুরক্ষা দেবে।
শুধু কৃষ্ণ সাগর নয়, পুরো ফ্রন্ট লাইনেই এই চুক্তি কার্যকর হবে।
যৌথ বিবৃতিতে আরও বলা হয়েছে, রাশিয়ার সম্মতির পরেই এটি কার্যকর হবে।
সাধারণত, যুদ্ধবিরতি চুক্তি হয় যুদ্ধরত পক্ষগুলোর মধ্যে।
তবে এখানে একটি পক্ষ (ইউক্রেন) এবং মধ্যস্থতাকারী দেশ (যুক্তরাষ্ট্র) মিলে চুক্তিটি করেছে।
বিবৃতিতে যুক্তরাষ্ট্র জানায়, তারা রাশিয়াকে বোঝাবে যে শান্তি প্রতিষ্ঠার চাবিকাঠি তাদের পারস্পরিক সম্মতির ওপর নির্ভর করছে।
ক্রেমলিনের মুখপাত্র দিমিত্রি পেসকভ সাংবাদিকদের জানান, রাশিয়া যুদ্ধবিরতি প্রস্তাবটি নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের কাছ থেকে বিস্তারিত জানার অপেক্ষায় রয়েছে।
এরপরই তারা প্রস্তাবটি গ্রহণ করবে কিনা, সে বিষয়ে মন্তব্য করবে।
যৌথ বিবৃতিতে আরও জানানো হয়, যুক্তরাষ্ট্র অবিলম্বে ইউক্রেনকে গোয়েন্দা তথ্য সরবরাহ এবং সামরিক সহায়তা দেওয়া শুরু করবে।
এর আগে, গত ২৮শে ফেব্রুয়ারি হোয়াইট হাউসে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প এবং জেলেনস্কির মধ্যে অনুষ্ঠিত একটি বৈঠকের ফল ভালো হয়নি।
এর জেরে যুক্তরাষ্ট্র ইউক্রেনকে সামরিক ও গোয়েন্দা সহায়তা বন্ধ করে দেয়।
উভয় দেশের প্রেসিডেন্ট ইউক্রেনের গুরুত্বপূর্ণ খনিজ সম্পদ নিয়ে একটি চুক্তি করতেও রাজি হয়েছেন।
খুব দ্রুতই এই চুক্তি সম্পন্ন করা হবে বলে বিবৃতিতে উল্লেখ করা হয়।
এর মাধ্যমে যুক্তরাষ্ট্র ইউক্রেনের খনিজ সম্পদে বিনিয়োগ করতে পারবে।
তবে, যৌথ বিবৃতিতে কিয়েভকে কোনো নিরাপত্তা নিশ্চয়তা দেওয়ার বিষয়ে সরাসরি কিছু বলা হয়নি।
জেলেনস্কি এমন নিশ্চয়তা চেয়ে আসছিলেন।
ট্রাম্প এই ধরনের নিরাপত্তা নিশ্চয়তা দেওয়ার ধারণা প্রত্যাখ্যান করেছেন।
অন্যদিকে, ভাইস প্রেসিডেন্ট জে ডি ভেন্স এক সাক্ষাৎকারে বলেন, ‘যদি আপনারা সত্যিকারের নিরাপত্তা নিশ্চয়তা চান এবং ভ্লাদিমির পুতিনকে পুনরায় ইউক্রেন আক্রমণ করা থেকে বিরত রাখতে চান, তাহলে ইউক্রেনের ভবিষ্যতে আমেরিকানদের অর্থনৈতিক সুবিধা দেওয়া সবচেয়ে ভালো উপায়।’
যুদ্ধবিরতি নিয়ে সৌদি আরবে অনুষ্ঠিত আলোচনাকে গঠনমূলক হিসেবে উল্লেখ করে জেলেনস্কি জানান, ইউক্রেনীয় দল তিনটি মূল বিষয় প্রস্তাব করেছে: আকাশপথে নীরবতা, অর্থাৎ কোনো পক্ষ ক্ষেপণাস্ত্র, বোমা বা দূরপাল্লার ড্রোন হামলা চালাবে না; সমুদ্রপথে নীরবতা; এবং বেসামরিক ও সামরিক বন্দী ও জোর করে রাশিয়া পাঠানো ইউক্রেনীয় শিশুদের মুক্তি।
জেলেনস্কি আরও লেখেন, কিয়েভ এই প্রস্তাব গ্রহণ করতে প্রস্তুত।
রাশিয়া রাজি হলে, অবিলম্বে যুদ্ধবিরতি কার্যকর হবে।
মার্কো রুবিও এক্সে দেওয়া পোস্টে জানান, ইউক্রেনের জন্য টেকসই শান্তি ফিরিয়ে আনতে তারা আরও একধাপ এগিয়েছেন।
এখন বল রাশিয়ার কোর্টে।
যুক্তরাষ্ট্র সামরিক সহায়তা বন্ধ করে দেওয়ার কারণ ব্যাখ্যা করে চ্যাথাম হাউসের সিনিয়র কনসালটিং ফেলো কেইর জাইলস বলেন, ‘ইউক্রেনকে যুদ্ধবিরতির রূপরেখায় রাজি করাতে এই পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছিল।
ইউক্রেনের কাছে এই চুক্তি মেনে নেওয়া ছাড়া কোনো উপায় ছিল না।’
সামরিক ও গোয়েন্দা তথ্য সরবরাহ বন্ধ হয়ে যাওয়ায় ইউক্রেনীয় বাহিনী ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছিল।
যুদ্ধ শুরুর আগে থেকেই যুক্তরাষ্ট্র ইউক্রেনকে গুরুত্বপূর্ণ গোয়েন্দা তথ্য দিয়ে আসছিল।
এর মাধ্যমে ইউক্রেন রাশিয়ার সম্ভাব্য হামলা সম্পর্কে জানতে পারত এবং রুশ সামরিক ঘাঁটিতে আঘাত হানতে সক্ষম হতো।
৫ই মার্চ, মার্কিন কর্মকর্তারা এই সহায়তা বন্ধের বিষয়টি নিশ্চিত করেন।
যুদ্ধবিরতি এখনো পর্যন্ত রাশিয়া গ্রহণ করেনি।
জাইলস বলেন, ‘অতিরিক্ত কিছু দাবি না করে রাশিয়া বর্তমান প্রস্তাব মেনে নেবে, এমনটা অস্বাভাবিক হবে।
যুদ্ধবিরতি মেনে নেওয়ার জন্য রাশিয়ার এখন অতিরিক্ত কিছু দাবি পেশ করার যথেষ্ট সুযোগ রয়েছে।’
জাইলস আরও জানান, রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন নিষেধাজ্ঞার শিথিলতা অথবা ইউক্রেনকে দেওয়া নিরাপত্তা নিশ্চয়তা সীমিত করার মতো অতিরিক্ত কিছু দাবি করতে পারেন।
২০২২ সালে যুদ্ধ শুরুর পর থেকে যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্ররা রাশিয়ার ওপর অন্তত ২১,৬৯২টি নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে।
এই নিষেধাজ্ঞাগুলো রাশিয়ার ব্যক্তি, গণমাধ্যম, সামরিক খাত, জ্বালানি খাত, বিমান চলাচল, জাহাজ নির্মাণ এবং টেলিযোগাযোগ খাতের ওপর দেওয়া হয়েছে।
অন্যদিকে, ট্রাম্প ৭ই মার্চ জানান, ইউক্রেনের সঙ্গে শান্তি চুক্তি না হওয়া পর্যন্ত তিনি রাশিয়ার ওপর নিষেধাজ্ঞা ও শুল্ক আরোপের বিষয়টি বিবেচনা করছেন।
যুদ্ধবিরতি নিয়ে আগামী কয়েক দিনের মধ্যে রাশিয়ার সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিনিধিদের যোগাযোগের সম্ভাবনা রয়েছে বলে রুশ বার্তা সংস্থা রিয়া জানিয়েছে।
ট্রাম্প বলেছেন, যুক্তরাষ্ট্র আগামী দিনগুলোতে রাশিয়ার সঙ্গে যোগাযোগ করবে।
দুই সূত্রের খবর অনুযায়ী, ট্রাম্পের মধ্যপ্রাচ্য বিষয়ক বিশেষ দূত স্টিভ উইটকফ আগামী দিনগুলোতে পুতিনের সঙ্গে কথা বলতে মস্কো যাওয়ার পরিকল্পনা করছেন।
গত মাসে যুদ্ধের শুরু থেকে উইটকফ প্রথম উচ্চপর্যায়ের মার্কিন কর্মকর্তা যিনি রাশিয়া সফর করেন।
জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা ওয়াল্টজ জেদ্দায় আলোচনার পর এক সংবাদ সম্মেলনে বলেন, ‘আমি আগামী কয়েক দিনের মধ্যে আমার রুশ প্রতিপক্ষের সঙ্গে কথা বলব।’
তথ্য সূত্র: আল জাজিরা