পোপ ফ্রান্সিস : হাসপাতালে দ্বাদশ বর্ষপূর্তি, সংস্কার ও বিতর্কের এক যুগ
বিশ্বের ১.৪ বিলিয়ন ক্যাথলিক ধর্মাবলম্বীর প্রধান, পোপ ফ্রান্সিস, হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় তাঁর দায়িত্ব গ্রহণের ১২ বছর পূর্ণ করেছেন। ফুসফুসে প্রদাহের কারণে হাসপাতালে ভর্তি হওয়ার চার সপ্তাহ পর তাঁর স্বাস্থ্য উন্নতির দিকে যাচ্ছে বলে জানা গেছে।
৮৮ বছর বয়সী পোপ ফ্রান্সিস ১৪ই ফেব্রুয়ারি রোমের জেমেলি হাসপাতালে ভর্তি হন। ভ্যাটিকান থেকে প্রকাশিত এক বিবৃতিতে বলা হয়েছে, তিনি স্থিতিশীল অবস্থায় আছেন। বুকের এক্স-রে পরীক্ষার ফলাফলে তাঁর শারীরিক অবস্থার উন্নতি হয়েছে। চিকিৎসকেরা জানিয়েছেন, তাঁর জীবন এখন আর ঝুঁকির মুখে নেই। তবে বয়স বিবেচনায় তাঁর শারীরিক দুর্বলতা রয়েছে।
২০১৩ সালে পোপ ষষ্ঠদশ বেনেডিক্টের পদত্যাগের পর, আর্জেন্টিনার কার্ডিনাল জর্জে মারিও বের্গোগলিওকে নতুন পোপ হিসেবে নির্বাচিত করা হয়। ১৩ই মার্চ, ২০১৩ তারিখে তিনি পোপ হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করেন।
পোপ ফ্রান্সিস তাঁর দায়িত্বের এই ১২ বছরে সহানুভূতি এবং শান্তির বার্তা বিশ্বজুড়ে ছড়িয়ে দিয়েছেন। তিনি ভ্যাটিকান সরকারের সংস্কার করেছেন এবং যাজকদের দ্বারা শিশুদের প্রতি যৌন নিপীড়নের বিরুদ্ধে কঠোর পদক্ষেপ নিয়েছেন।
পোপের দায়িত্ব গ্রহণের পর যাজকদের দ্বারা শিশুদের উপর যৌন নির্যাতনের ঘটনা ছিল তাঁর জন্য সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জগুলোর একটি। ২০১৮ সালে, চিলিতে এক সফরের সময় তিনি এই বিষয়ে কিছু ভুল স্বীকার করেন, যা তাঁর জন্য গুরুত্বপূর্ণ একটি মুহূর্ত ছিল। তিনি চিলির বিশপদের ভ্যাটিকানে ডেকে পাঠান এবং তাঁদের পদত্যাগ করার নির্দেশ দেন। পরে, তিনি মার্কিন যাজক থিওডোর ম্যাককারিকের কার্ডিনাল পদ বাতিল করেন এবং ২০১৯ সালে তাঁকে যাজক পদ থেকে সরিয়ে দেন। একই বছর, তিনি ভুক্তভোগীদের সঙ্গে এক শীর্ষ সম্মেলনে মিলিত হন এবং তাঁদেরকে নিপীড়ন বিরোধী লড়াইয়ের প্রতিশ্রুতি দেন।
পোপ ফ্রান্সিস ভ্যাটিকানের অভ্যন্তরীণ কার্যক্রমেও পরিবর্তন এনেছেন। তিনি ভ্যাটিকানের আর্কাইভগুলো উন্মুক্ত করেছেন এবং ধর্মীয় আদালতে সাধারণ মানুষের অংশগ্রহণের সুযোগ তৈরি করেছেন। এছাড়া, নির্যাতনের শিকার শিশুদের অভিযোগ জানানো এবং তা গোপন করার চেষ্টা করলে, তা কর্তৃপক্ষের কাছে জানানো বাধ্যতামূলক করেছেন।
তবে, কিছু মানবাধিকার কর্মী মনে করেন, পোপ এই বিষয়ে যথেষ্ট পদক্ষেপ নেননি। তাঁদের মতে, ক্যাথলিক চার্চে এখনো স্বচ্ছতার অভাব রয়েছে এবং বাইরের পর্যবেক্ষণের সুযোগ কম।
পোপ ফ্রান্সিস বিভিন্ন দেশে ভ্রমণ করেছেন এবং প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর প্রতি মনোযোগ দিয়েছেন। তিনি নিয়মিতভাবে সুদান, গাজা ও ইউক্রেনের মতো সংঘাতপূর্ণ অঞ্চলে শান্তির আহ্বান জানিয়েছেন এবং ইসলামসহ অন্যান্য ধর্মের সঙ্গে সংলাপের ওপর জোর দিয়েছেন। গত নভেম্বরে তিনি গাজায় ইসরায়েলের গণহত্যা হচ্ছে কিনা, তা তদন্তের আহ্বান জানান।
আর্জেন্টিনায় ইতালীয় অভিবাসী পরিবারে জন্ম নেওয়া পোপ ফ্রান্সিস অভিবাসীদের অধিকারের পক্ষে জোরালোভাবে কথা বলেছেন। তিনি যুক্তরাষ্ট্রের তৎকালীন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের ব্যাপকহারে অভিবাসী বিতাড়নের পরিকল্পনার সমালোচনা করেছিলেন। ইতালির ল্যাম্পেডুসা দ্বীপে তিনি উত্তর আফ্রিকা থেকে আসা অভিবাসীদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন।
পোপ ফ্রান্সিস পরিবেশ সুরক্ষার একজন সক্রিয় কর্মী। ২০১৫ সালে প্রকাশিত তাঁর “লাউদাতো সি” (“তুমি মহিমান্বিত”) শীর্ষক বিশ্ব-ঐক্য ঘোষণায় জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলায় দ্রুত পদক্ষেপ নেওয়ার জন্য ধনী দেশগুলোর প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন।
সংস্কারপন্থী হিসেবে পরিচিত পোপ ফ্রান্সিস বিবাহবিচ্ছেদ এবং এলজিবিটিকিউ সদস্যদের অন্তর্ভুক্তিসহ ক্যাথলিক চার্চকে আরও উদার করার চেষ্টা করেছেন। তাঁর এই পদক্ষেপ রক্ষণশীলদের মধ্যে অসন্তোষ সৃষ্টি করেছে। বিশেষ করে, ২০২৩ সালে তিনি সমকামী যুগলদের আশীর্বাদ করার অনুমতি দিলে, আফ্রিকা ও যুক্তরাষ্ট্রের কিছু অংশে এর তীব্র প্রতিক্রিয়া হয়। জার্মানির কার্ডিনাল গেরহার্ড মুলার তাঁর এই সিদ্ধান্তকে “মতাদর্শগত বিভ্রান্তি” হিসেবে বর্ণনা করেছেন।
ক্ষমতা বিকেন্দ্রীকরণ, স্বচ্ছতা বৃদ্ধি, সাধারণ মানুষ ও নারীদের জন্য আরও বেশি সুযোগ তৈরি করাসহ পোপ ফ্রান্সিস ভ্যাটিকানের প্রশাসনিক কাঠামোতেও গুরুত্বপূর্ণ সংস্কার করেছেন। এই সংস্কারগুলোর মধ্যে রয়েছে, ২০১৪ সালে একটি বিশেষ অর্থনৈতিক সচিবালয় তৈরি করা, দুর্নীতি দমন এবং ভ্যাটিকান ব্যাংকের বিনিয়োগের ওপর নজরদারি বৃদ্ধি করা।
পোপ ফ্রান্সিস ক্যাথলিক আলোচনার ফোরাম, সিনডকে নতুন রূপ দিয়েছেন, যেখানে সাধারণ মানুষ ও নারীদেরও অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। ২০২১ সাল থেকে সিনড চার্চের ভবিষ্যৎ নিয়ে কাজ করছে। তবে নারীদের ডিকন হওয়ার মতো গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্তগুলো এখনো চূড়ান্ত হয়নি।
পোপ ফ্রান্সিসের সংস্কার কার্যক্রম কিছু ক্ষেত্রে বিরোধিতার সম্মুখীন হয়েছে। কেউ কেউ তাঁকে “স্বৈরাচারী” বলেও অভিযুক্ত করেছেন।
তথ্য সূত্র: আল জাজিরা