ইরানের অর্থনীতিকে স্থিতিশীল রাখতে দেশটির সোনা আমদানির ওপর ব্যাপক মনোযোগ বর্তমানে আলোচনার বিষয়। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কঠোর অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞার মধ্যে তেহরান এই পদক্ষেপ নিয়েছে। গত কয়েক মাসে দেশটি বিপুল পরিমাণ সোনা আমদানি করেছে, যা তাদের অর্থনীতির জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ কৌশল হিসেবে দেখা হচ্ছে।
আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যম সূত্রে জানা যায়, ইরানের প্রেসিডেন্ট মাসউদ পেজেশকিয়ানের সরকার দেশটির অর্থনীতির ওপর মার্কিন চাপ মোকাবিলায় বিভিন্ন পদক্ষেপ নিচ্ছে। এর অংশ হিসেবে সোনার মজুত বাড়ানো হচ্ছে, যা তাদের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভকে স্থিতিশীল রাখতে সহায়তা করবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। ইরানের কাস্টমস প্রশাসন জানিয়েছে, চলতি ইরানি ক্যালেন্ডার বর্ষের দশম মাস দেয়ার (জানুয়ারী ১৯ পর্যন্ত) শেষ পর্যন্ত দেশটি অন্তত ৮১ মেট্রিক টন সোনার বার আমদানি করেছে। এই আমদানির পরিমাণ আগের বছরের একই সময়ের তুলনায় মূল্যের দিক থেকে ৩০০ শতাংশ এবং ওজনের দিক থেকে ২৩৪ শতাংশ বেশি।
ফেব্রুয়ারির শেষের দিকে দেশটির নতুন কাস্টমস প্রধান ফোরুদ আসগারী সাংবাদিকদের জানান, রপ্তানি পণ্যের বিনিময়ে ১০০ টনের বেশি সোনা আমদানি করা হয়েছে। এই পরিমাণ গত বছরের তুলনায় তিন গুণেরও বেশি। ডিসেম্বরে দেশটির কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রধান মোহাম্মদ রেজা ফারজিন দাবি করেন, দেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের ২০ শতাংশ সোনায় রূপান্তর করা হয়েছে। বর্তমানে বিশ্বে ইরানের সোনার রিজার্ভের অনুপাত বেশ উল্লেখযোগ্য।
বিশ্লেষকদের মতে, ইরানের এই সোনা আমদানির পেছনে প্রধান কারণ হলো মার্কিন নিষেধাজ্ঞা এবং এর ফলে দেশটির অর্থনীতির ওপর পড়া বিরূপ প্রভাব। দেশটির মুদ্রা দুর্বল হয়ে যাওয়ায় এবং আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে নানা ধরনের সীমাবদ্ধতা তৈরি হওয়ায় সোনা একটি নিরাপদ আশ্রয় হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে।
ইরানের সাধারণ মানুষও তাদের সঞ্চয়কে মুদ্রাস্ফীতি থেকে বাঁচাতে সোনার দিকে ঝুঁকছে। দেশটির কেন্দ্রীয় ব্যাংক বিভিন্ন ধরনের সোনার কয়েন বিক্রি করছে এবং জনসাধারণের মধ্যে সোনা কেনার প্রবণতা বাড়ছে। উদাহরণস্বরূপ, গত বছর ইসলামিক মাস সাফার মাসের ১৩ তারিখে অনেকে সৌভাগ্য লাভের আশায় সোনা কিনেছিল। যদিও, কর্তৃপক্ষের পক্ষ থেকে মাঝে মাঝে জালিয়াতি এড়াতে শুধুমাত্র অনুমোদিত বিক্রেতাদের কাছ থেকে সোনা কেনার জন্য সতর্ক করা হচ্ছে।
তবে, ইরানের এই সোনা নির্ভরতা নিয়ে বিতর্কও রয়েছে। বিশ্লেষকরা বলছেন, সোনার এই কৌশল দেশটির অর্থনীতির দীর্ঘমেয়াদি সমস্যা সমাধানে খুব বেশি কার্যকর হবে না। তাদের মতে, বাজারের খেলোয়াড়রা সরকারের দুর্বলতা সম্পর্কে অবগত এবং এতে জনসাধারণের মধ্যে আস্থা ফেরানো কঠিন।
অর্থনীতিবিদ ও বাজার বিশ্লেষক মেহদি হাগবালি মনে করেন, সরকারের এই পদক্ষেপ মুদ্রাস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে তেমন কোনো প্রভাব ফেলবে না। বরং, এতে জনসাধারণের মধ্যে ভুল ধারণা তৈরি হতে পারে। তিনি আরও বলেন, সরকারের উচিত দেশের সামগ্রিক অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক অবস্থার উন্নতি ঘটানো, যা বাজারের ওপর ইতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে।
অন্যদিকে, ইরানের একজন অনুসন্ধানী সাংবাদিক ইয়ার সোলতানি অভিযোগ করেছেন যে, প্রায় ৬১ টনের বেশি সোনা “নিখোঁজ” রয়েছে, যা বাজারে সরবরাহ করা হয়নি। কেন্দ্রীয় ব্যাংক এই অভিযোগ অস্বীকার করে তার বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নেওয়ার কথা বলেছে।
বর্তমানে, ইরান সরকার একদিকে যেমন সোনার আমদানি বাড়াচ্ছে, তেমনি স্থানীয়ভাবে সোনার উৎপাদন বাড়ানোর চেষ্টা করছে। তবে, দেশটির এই সোনা নির্ভরতা কতটুকু ফলপ্রসূ হবে, তা সময়ই বলবে।
তথ্য সূত্র: আল জাজিরা