যুদ্ধবিরতির আলোচনা ভেস্তে যাওয়ার সম্ভবনা: রাশিয়ার ভূখণ্ডে সেনা হারানোর পর দর কষাকষির ক্ষমতা হারাচ্ছে ইউক্রেন
ইউক্রেন এবং রাশিয়ার মধ্যে সম্ভাব্য যুদ্ধবিরতির আলোচনার মধ্যে কিয়েভ কার্যত দর কষাকষির একটি গুরুত্বপূর্ণ অস্ত্র হারাতে বসেছে। রাশিয়ার অভ্যন্তরে ইউক্রেনীয় সৈন্যদের পিছু হটার ফলে এমন পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে। গত আগস্ট মাসে ইউক্রেনীয় সেনারা রাশিয়ার সীমান্ত অতিক্রম করে প্রায় ১,৩০০ বর্গকিলোমিটার এলাকা নিজেদের নিয়ন্ত্রণে নিয়ে আসে। এটি ছিল ইউক্রেনের জন্য একটি বড় ধরনের মনোবল যোগানোর মতো ঘটনা। তবে এর থেকেও গুরুত্বপূর্ণ ছিল, ইউক্রেনের নেতারা মনে করেছিলেন, রাশিয়ার ভূখণ্ড দখলের মাধ্যমে তারা ভবিষ্যতে শান্তি আলোচনার টেবিলে সুবিধা আদায় করতে পারবে।
কিন্তু বর্তমানে, উত্তর কোরিয়ার সৈন্যদের সহায়তায় রাশিয়ার তীব্র প্রতিরোধের মুখে ইউক্রেনীয় সেনারা তাদের দখল করা এলাকার মাত্র ৩০ শতাংশ ধরে রাখতে সক্ষম হয়েছে। এছাড়া, সুজা শহরে দ্রুত পরাজয়ের পর তাদের সেনারা পিছু হটতে বাধ্য হচ্ছে।
বৃহস্পতিবার, ইউক্রেনীয় সেনাবাহিনী সীমান্ত এলাকার কাছে প্রতিরক্ষামূলক ব্যূহ তৈরি করার চেষ্টা করছে, যাতে সুজা শহর থেকে রাশিয়ার সেনারা উত্তর-পূর্ব ইউক্রেনে প্রবেশ করতে না পারে।
রাজনৈতিকভাবে, রাশিয়ার কুর্স্ক অঞ্চলের বিশাল অংশ থেকে সেনা প্রত্যাহার ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কি এবং তার সামরিক উপদেষ্টাদের জন্য একটি কঠিন মুহূর্ত তৈরি করতে পারে। কুর্স্ক অভিযানের মূল উদ্দেশ্য ছিল ইউক্রেনের অভ্যন্তর থেকে রাশিয়ার সেনাদের সরিয়ে আনা। এর মাধ্যমে ২০১৪ সাল থেকে রাশিয়া কর্তৃক অধিকৃত ইউক্রেনের প্রায় ২০ শতাংশ ভূখণ্ড পুনরুদ্ধারেরও একটি সুযোগ ছিল।
তবে অনেক সেনা ও কমান্ডার শুরু থেকেই এই অভিযানের প্রয়োজনীয়তা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছিলেন। তাদের মতে, ইউক্রেনকে রক্ষার জন্য সৈন্যদের সরিয়ে নেওয়াটা সঠিক সিদ্ধান্ত ছিল না। কুর্স্ক থেকে পিছু হটার পর সেই সন্দেহ আরও বেড়ে যায়।
রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন বৃহস্পতিবার বলেছেন, তিনি ইউক্রেনে ৩০ দিনের যুদ্ধবিরতির জন্য যুক্তরাষ্ট্রের প্রস্তাবের সঙ্গে নীতিগতভাবে একমত। তবে বিস্তারিত বিষয়গুলো এখনও চূড়ান্ত করতে হবে। পুতিন এমন মন্তব্য করেছেন, যখন সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের একজন দূত মস্কো সফর করেন।
কুর্স্কে পরাজয়ের পর, সুজা শহরের নিয়ন্ত্রণ হারানো ইউক্রেনের জন্য একটি বড় ধাক্কা। এই শহরটির যুদ্ধের আগে জনসংখ্যা ছিল ৫,০০০। সুজা পতনের পর ইউক্রেনীয় সেনারা রাশিয়ার ওই অঞ্চলে তাদের অবশিষ্ট ভূমি ধরে রাখতে পারবে কিনা, তা নিয়ে সন্দিহান। তারা পরাজয়ের রাজনৈতিক গুরুত্বও উপলব্ধি করতে পারছে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন ইউক্রেনীয় কমান্ডার বলেন, “আমি বুঝি, রাশিয়া কুর্স্ক পুনরুদ্ধারের জন্য (যুদ্ধবিরতি) আলোচনা বিলম্বিত করছে, এবং তারপরই তারা কথা বলবে। কিন্তু আমাদের ভূখণ্ড ফিরিয়ে আনার মতো কোনো প্রভাব বিস্তারের ক্ষমতা থাকবে না।
যুদ্ধক্ষেত্রে উত্তর কোরিয়ার সৈন্যদের উপস্থিতি পরিস্থিতি পরিবর্তন করেছে। সৈন্যদের মতে, গত বছর উত্তর কোরিয়ার সেনারা যুদ্ধক্ষেত্রে আসার পরেই তাদের প্রতিরোধ ক্ষমতা দুর্বল হতে শুরু করে। ইউক্রেনের একটি ড্রোন অপারেটর কয়েক সপ্তাহ আগে একটি গাছের সারিতে প্রায় ৪০ জন উত্তর কোরিয়ার সৈন্যকে দেখতে পান। তিনি তাদের শারীরিক সক্ষমতা দেখে অবাক হয়েছিলেন। এমনকি ভারী গোলাবারুদ বহন করেও তারা দ্রুত দৌড়াতে পারছিল।
এছাড়াও, জনবল, অস্ত্রশস্ত্র এবং গোলাবারুদের অভাব ইউক্রেনীয় সৈন্যদের জন্য একটি বড় সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে। সৈন্যদের মতে, কিছু কিছু এলাকায় তারা প্রতিপক্ষের চেয়ে ৫ থেকে ১০ গুণ পর্যন্ত কম ছিল।
গত তিন মাসে, রুশ সেনারা ধীরে ধীরে ইউক্রেনীয়দের দুর্বল করে দিয়েছে। রাশিয়ার বিমান হামলার কারণে ইউক্রেনীয় সৈন্যদের গোলাবারুদ, খাদ্য ও চিকিৎসা সামগ্রী নিয়ে ২০ থেকে ৩০ কিলোমিটার পথ পাড়ি দিতে হয়েছে।
ইউক্রেনীয় সেনাবাহিনীর শীর্ষ কমান্ডার জেনারেল ওলেক্সান্ডার সিরস্কি বুধবার সৈন্যদের কুর্স্কে আরও সুবিধাজনক অবস্থানে সরে যাওয়ার নির্দেশ দেন। তিনি বলেন, সৈন্যদের জীবন বাঁচানোই তার প্রধান অগ্রাধিকার।
তবে কিছু সৈন্যের মতে, এই সিদ্ধান্ত আরও আগে নেওয়া উচিত ছিল। একজন ইউক্রেনীয় সৈন্য বলেন, তিনি এবং তার সঙ্গীরা তাদের কোম্পানির কমান্ডারের নির্দেশ অমান্য করে নিজেরাই পশ্চাদপসরণের সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। তিনি বলেন, “আমরা সবসময় গুলির মধ্যে থাকতে থাকতে ক্লান্ত হয়ে পড়েছি।
বর্তমানে রাশিয়ার সেনারা সুজা থেকে ইউক্রেনীয় সৈন্যদের পালানোর পথ বন্ধ করে দিচ্ছে।
তথ্য সূত্র: অ্যাসোসিয়েটেড প্রেস