মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে অভিবাসন কর্তৃপক্ষের সঙ্গে নিয়মিত সাক্ষাতগুলো এখন উদ্বেগের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। এমনকি যারা আশ্রয়ের জন্য আবেদন করেছেন, তাদেরও আটক করা হচ্ছে। এমনটাই জানা যাচ্ছে বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমের খবর থেকে। ট্রাম্প প্রশাসনের সময়ে অভিবাসন নীতিতে পরিবর্তন আসার পর থেকে এই পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে, যা অভিবাসী সম্প্রদায়ের মধ্যে গভীর উদ্বেগ সৃষ্টি করেছে।
কলম্বিয়ার এক দম্পতি বিয়ের পরিকল্পনা করছিলেন। তারা যখন যুক্তরাষ্ট্রের অভিবাসন কর্তৃপক্ষের সঙ্গে দেখা করতে যান, তখন তাদের মধ্যে একজনকে আটক করে ডিটেনশন সেন্টারে পাঠানো হয়। পরে তাকে নিজ দেশে ফেরত পাঠানো হয়। জোহান নামের ওই ব্যক্তি জানিয়েছেন, কেন ৫ই ফেব্রুয়ারি, ফেডারেল ইমিগ্রেশন অ্যান্ড কাস্টমস এনফোর্সমেন্ট (ICE)-এর সঙ্গে সাক্ষাতে তার সঙ্গীকে আটক করা হয়েছিল, সে বিষয়ে তিনি কিছুই জানেন না। ভয়ে তিনি পরের মাসের নির্ধারিত সাক্ষাতেও যাননি। জোহান আশঙ্কা প্রকাশ করে বলেছেন, প্রতিশোধের ভয়ে তিনি তার পুরো নাম প্রকাশ করতে চান না।
বর্তমানে অনেকেই আশঙ্কা করছেন, নিয়মিত অভিবাসন বিষয়ক সাক্ষাৎগুলো তাদের আটকের কারণ হতে পারে। কারণ, প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প গণ-নির্যাতনের একটি প্রচার অভিযান চালাচ্ছেন, যার ফলস্বরূপ ICE হেফাজতে থাকা মানুষের সংখ্যা ২০১৯ সালের নভেম্বরের পর সর্বোচ্চ পর্যায়ে পৌঁছেছে।
আসলে, যাদের সরকার মুক্তি দিয়েছে এবং যারা উদ্বাস্তু হিসেবে আশ্রয়ের আবেদন করেছেন, তাদের গতিবিধি নজরে রাখতেই এই সাক্ষাতের ব্যবস্থা করা হয়। অভিবাসন বিষয়ক আদালতের দীর্ঘসূত্রিতার কারণে এই প্রক্রিয়া চলে। তবে, ঠিক কতজন মানুষকে এভাবে আটক করা হয়েছে, সে বিষয়ে সরকার কোনো তথ্য জানায়নি। এমনকি, এটি এখন নিয়মিত প্রক্রিয়া কি না, সে বিষয়েও কিছু জানা যায়নি। তবে অভিবাসন বিষয়ক আইনজীবী ও কর্মীরা আশঙ্কা করছেন, এমন পরিস্থিতিতে অনেক মানুষ কর্তৃপক্ষের কাছে হাজিরা দেওয়া বন্ধ করে দিতে পারেন, যা তাদের আরও বেশি ঝুঁকির মধ্যে ফেলবে।
“যদি আপনি যান, তবে তারা আপনাকে বিতাড়িত করবে। আর যদি না যান, তবুও বিতাড়িত করা হবে,” এমনটাই জানিয়েছেন ২৩ বছর বয়সী জোহান।
মার্কিন সরকার এ বিষয়ে বিস্তারিত কোনো তথ্য জানায়নি। অভিবাসন বিষয়ক সংস্থা ICE এবং এর মূল সংস্থা, ডিপার্টমেন্ট অব হোমল্যান্ড সিকিউরিটি, অভিবাসীদের আটকের বিষয়ে বারবার মন্তব্য জানতে চাইলেও, তারা কোনো সাড়া দেয়নি।
ফেডারেল সরকার সামান্যই তথ্য প্রকাশ করায়, অভিবাসী সমাজে আতঙ্ক বাড়ছে এবং গুজব ছড়িয়ে পড়ছে। ট্রাম্প ক্ষমতা গ্রহণের পর থেকেই অবৈধভাবে বসবাসকারীদের বিতাড়িত করার ওপর জোর দিয়েছেন। তিনি ক্ষমতায় আসার আগে জো বাইডেন শুধুমাত্র তাদের উপর নজর রাখতেন, যারা জননিরাপত্তা বা জাতীয় নিরাপত্তার জন্য হুমকি ছিল অথবা সীমান্ত অতিক্রম করার সময় ধরা পড়ত।
গত বুধবার, ICE-এর একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা জানিয়েছেন, ট্রাম্প দায়িত্ব নেওয়ার পর থেকে সংস্থাটি ৩২,৮০৯ জনকে গ্রেপ্তার করেছে। বর্তমানে প্রায় ৪৭,৬০০ জন ICE হেফাজতে রয়েছে। এই কর্মকর্তা প্রশাসনের নির্দেশিকা অনুযায়ী, নাম প্রকাশ না করার শর্তে সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলেছেন।
গত চার বছরে এই প্রথম, ICE কাস্টমস অ্যান্ড বর্ডার প্যাট্রোল (CBP)-এর চেয়ে বেশি সংখ্যক মানুষকে গ্রেপ্তার করেছে। এর থেকে বোঝা যায়, সীমান্তে আটকের চেয়ে বর্তমানে দেশের অভ্যন্তরে বেশি অভিবাসীকে আটক করা হচ্ছে।
বিভিন্ন কারণে ICE অভিবাসীদের সাক্ষাতের জন্য ডাকে। এর মধ্যে একটি কারণ হলো আদালতের শুনানির তারিখ জানানো। যদি কোনো অভিবাসী এই সময়ে কোনো আইন ভঙ্গ করে বা আদালত তাদের যুক্তরাষ্ট্রে থাকার আবেদন প্রত্যাখ্যান করে, তবে ICE তাদের আটক করে বিতাড়িত করতে পারে।
লুইজিয়ানায়, গত মাসে ICE একজন অভিবাসীকে আটক করে, যিনি একটি কম নজরদারির প্রোগ্রামের জন্য উপযুক্ত হতে পারেন—এমন কথা বলে তাকে ডেকেছিল। তবে, এই বিষয়ে বিস্তারিত কিছু জানায়নি আমেরিকান সিভিল লিবার্টিজ ইউনিয়ন অব লুইজিয়ানা।
কিছু আইনজীবী তাদের মক্কেলদের পরামর্শ দিচ্ছেন, যেন তারা এই ধরনের সাক্ষাৎ এড়িয়ে না যান। কারণ, এটি করলে তাদের বিতাড়িত করার নির্দেশ আসতে পারে। পরিবর্তে, আইনজীবীরা অভিবাসীদের এই ধরনের অ্যাপয়েন্টমেন্টের জন্য প্রস্তুত থাকতে এবং আটকের সম্ভাবনা সম্পর্কে সতর্ক থাকতে বলছেন। তারা অভিবাসীদের তাদের সাক্ষাতের পদ্ধতিতে হঠাৎ পরিবর্তন হলে, যেমন—আগে ভার্চুয়ালি হওয়া অ্যাপয়েন্টমেন্ট এখন সরাসরি করা হলে, সেদিকে খেয়াল রাখতে বলছেন।
এছাড়াও, তারা অভিবাসীদের জরুরি পরিস্থিতিতে তাদের শিশুদের দেখাশোনার ব্যবস্থা করতে এবং তাদের মামলার বিস্তারিত তথ্য বন্ধু ও পরিবারের সঙ্গে শেয়ার করতে উৎসাহিত করছেন। এর মধ্যে ICE-এর দেওয়া একটি বিশেষ শনাক্তকরণ নম্বরও শেয়ার করতে বলা হচ্ছে, যা দিয়ে তারা তাদের গতিবিধি ট্র্যাক করে।
অভিবাসী অধিকার সংগঠনগুলো বলছে, ICE-এর সঙ্গে সাক্ষাতে যাওয়ার সময় একজন আইনজীবীসহ অন্য কাউকে সঙ্গে নিয়ে যাওয়া উচিত।
পাশাপাশি, অভিবাসী অধিকার কর্মীরা ট্রাম্পের আগের মেয়াদের কৌশল ফিরিয়ে এনেছেন। তারা বলছেন, সাক্ষাৎকালে কিছু সমর্থক যেন তাদের সঙ্গে যান এবং বাইরে অপেক্ষা করেন।
ন্যাশনাল ইমিগ্রেশন ল’ সেন্টারের নীতি বিষয়ক ভাইস প্রেসিডেন্ট, হাইডি অল্টম্যান বলেছেন, “যখন মানুষ মনে করে তাদের রিপোর্ট করতে যাওয়া নিরাপদ নয়, তখন সবকিছু ব্যর্থ হওয়ার সম্ভবনা থাকে। এটি মানুষের মধ্যে আস্থার অভাব তৈরি করে।
তথ্যসূত্র: এসোসিয়েটেড প্রেস