পশ্চিম তীরে ইসরায়েলি চেকপোস্ট ও ব্যারিকেডের কারণে ফিলিস্তিনিদের জীবনযাত্রা চরম দুর্ভোগের শিকার, বাড়ছে মানবিক সংকট
ফিলিস্তিনের পশ্চিম তীরে ইসরায়েলি কর্তৃপক্ষ নতুন করে অসংখ্য চেকপোস্ট ও নিরাপত্তা বেষ্টনী তৈরি করায় সেখানকার ফিলিস্তিনি জনগণের জীবনযাত্রা মারাত্মকভাবে ব্যাহত হচ্ছে। গাজা উপত্যকায় যুদ্ধবিরতি ঘোষণার পরও এই অঞ্চলে ফিলিস্তিনিদের ওপর দুর্ভোগ যেন বেড়েই চলেছে। যোগাযোগ ব্যবস্থা বিপর্যস্ত হওয়ায় জরুরি পরিষেবা থেকে শুরু করে শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও ব্যবসা-বাণিজ্য—সবকিছুতেই পড়েছে এর নেতিবাচক প্রভাব।
রামাল্লাহ থেকে আতারা গ্রামের দিকে যেতে সাধারণত সময় লাগে আধঘণ্টার মতো। কিন্তু এখন রাস্তায় তৈরি হওয়া অসংখ্য চেকপোস্টের কারণে এই পথ পাড়ি দিতে ঘণ্টার পর ঘণ্টা সময় লাগছে। অনেক সময় দিনের অর্ধেক সময়ও লেগে যাচ্ছে। সেখানকার ট্যাক্সিচালক আহমেদ বারগুতির (৫০) কথায় সেই উদ্বেগের চিত্র ফুটে ওঠে। তিনি বলেন, “যাত্রাপথে কখন যে কত সময় লাগবে, তা বলা কঠিন। চেকপোস্টগুলোতে কখন কী হয়, তা কেউ জানে না।”
গত বছরের অক্টোবর মাস থেকে গাজায় ইসরায়েলি আগ্রাসন শুরুর পর থেকে পশ্চিম তীরে কমপক্ষে ১১৯টি ‘লোহার গেট’ বসানো হয়েছে। এসব গেট বসানোর ফলে গ্রাম ও শহরগুলোর মধ্যে সংযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে, যা সেখানকার সাধারণ মানুষের জীবনকে দুর্বিষহ করে তুলেছে। ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষের হিসাব অনুযায়ী, বর্তমানে পশ্চিম তীরে প্রায় ৯০০টি নিরাপত্তা বেষ্টনী রয়েছে। জাতিসংঘের তথ্যমতে, এই সংখ্যা ৮০০ ছাড়িয়ে গেছে, যা ২০২৩ সালের তুলনায় অনেক বেশি।
ফিলিস্তিনি কর্মকর্তারা বলছেন, চেকপোস্ট বসানোর এই নতুন কৌশল মূলত পুরো পশ্চিম তীরকে কয়েকটি অঞ্চলে বিভক্ত করার পরিবর্তে, এখন ভূমি, কৃষি, সামাজিক সুযোগ, স্বাস্থ্য ও অর্থনীতির ওপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার দিকে বেশি মনোযোগ দিচ্ছে। এর ফলে স্থানীয় ফিলিস্তিনিদের মধ্যে চরম অনিশ্চয়তা তৈরি হয়েছে।
একটি সমীক্ষায় দেখা গেছে, পশ্চিম তীরে কাজ করা এনজিওগুলোর মধ্যে ৯৩ শতাংশের বেশি জানিয়েছে, চেকপোস্ট ও ভ্রমণের ওপর নিষেধাজ্ঞার কারণে ত্রাণ বিতরণ বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। আতারা গ্রামের বাসিন্দা বারগুতি বলেন, “প্রতিটি গ্রামে এখন একটি করে গেট বসানো হয়েছে, যেন আমরা ভেড়ার পালের মতো বন্দী হয়ে গেছি।”
আর্থিক সংকটের শিকার হয়েছেন নির্মাণ শ্রমিক আবু ওসামা (৭০)। তিনি বলেন, “যুবকদেরও যখন কাজ নেই, তখন আমার মতো বয়স্ক মানুষকে কে কাজ দেবে?” আগে তিনি ইসরায়েলে গিয়ে কাজ করতেন, কিন্তু এখন নিরাপত্তার কারণে ইসরায়েলি কর্তৃপক্ষ কোনো অনুমতি দিচ্ছে না। এমনকি পবিত্র রমজান মাসেও তিনি আল-আকসা মসজিদে নামাজ পড়তে যেতে পারেননি।
এদিকে, ইসরায়েলি কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, তারা শুধুমাত্র সীমিত সংখ্যক ফিলিস্তিনিকে জেরুজালেমে প্রবেশের অনুমতি দিয়েছে। তাদের যুক্তি, অস্থিরতা এড়াতে এই ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। তবে ফিলিস্তিনিদের এমন অভিযোগের বিপরীতে ইসরায়েলি কর্তৃপক্ষের বক্তব্য হলো, নিরাপত্তা হুমকির কারণে তারা এই পদক্ষেপ নিতে বাধ্য হয়েছে।
আরেকজন ভুক্তভোগী, উম্মু ওমর (৩৬)। তিনি জানান, চেকপোস্টের কারণে রামাল্লাহ থেকে নিজের গ্রামে ফিরতে তাকে অনেক ভোগান্তি পোহাতে হয়েছে। কখন কোন চেকপোস্ট খোলা থাকে, তা জানার জন্য তিনি বিভিন্ন অ্যাপ ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের ওপর নির্ভর করেন।
ইসরায়েলি সামরিক বাহিনী জানিয়েছে, তারা ফিলিস্তিনিদের নিরাপত্তা এবং সশস্ত্র গোষ্ঠীর হামলা প্রতিরোধের জন্য এই পদক্ষেপ নিয়েছে। তাদের দাবি, চেকপোস্ট বসানোর ফলে অস্ত্র ও সন্ত্রাসী কার্যকলাপ ধরা পড়ছে, যা নিরাপত্তা পরিস্থিতির উন্নতিতে সাহায্য করছে।
আতারার এক ব্যবসায়ী শোয়াইল শাদের (৭৬) মতে, পরিস্থিতি আগে কখনো এত খারাপ ছিল না। তিনি বলেন, “ব্যবসা প্রায় বন্ধ হয়ে গেছে, মানুষের হাতে টাকা নেই। গাজায় যুদ্ধবিরতি হওয়ার পর ভেবেছিলাম পরিস্থিতি ভালো হবে, কিন্তু বাস্তবে তা আরও খারাপ হয়েছে।”
তথ্য সূত্র: দ্য গার্ডিয়ান