ইউক্রেনে সামরিক সহায়তা বন্ধের জন্য রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের দাবিকে কার্যত অগ্রাহ্য করে দেশটির প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা জোরদারে দৃঢ় পদক্ষেপ নিচ্ছে ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ)। যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমা দেশগুলোর সঙ্গে রাশিয়ার আলোচনা চললেও, ইউরোপীয় ইউনিয়ন এক্ষেত্রে ইউক্রেনকে সামরিক ও অর্থনৈতিকভাবে শক্তিশালী করতে ‘শজারু কৌশল’ (Porcupine Strategy) গ্রহণ করেছে।
এই কৌশলের মূল লক্ষ্য হলো ইউক্রেনের সামরিক সক্ষমতা বৃদ্ধি করা, যাতে দেশটি রাশিয়ার বিরুদ্ধে আরও শক্তিশালী প্রতিরোধ ব্যবস্থা গড়ে তুলতে পারে।
জার্মান চ্যান্সেলর ওলাফ শোলজ সম্প্রতি এক ইইউ সম্মেলনে বলেন, ইউক্রেনের স্বাধীনতা, গণতন্ত্র এবং ইইউ সদস্যপদ লাভের আকাঙ্ক্ষা বজায় রাখা অত্যন্ত জরুরি।
তিনি জোর দিয়ে বলেন, শান্তি চুক্তির পরেও ইউক্রেনের একটি শক্তিশালী সেনাবাহিনী থাকা দরকার। শোলজ আরও জানান, ইইউ এবং এর মিত্র দেশগুলো ইউক্রেনকে উল্লেখযোগ্য সহায়তা অব্যাহত রাখবে।
শোলজের এই বক্তব্যের কয়েক ঘণ্টা পরেই হাঙ্গেরি বাদে ইইউ’র অন্য সদস্য রাষ্ট্রগুলো ইউক্রেনের জরুরি সামরিক ও প্রতিরক্ষা চাহিদা মেটাতে দ্রুত পদক্ষেপ নেওয়ার আহ্বান জানায়।
উল্লেখ্য, হাঙ্গেরি এই জোটের ‘শক্তির মাধ্যমে শান্তি’ নীতির বিরোধিতা করে আসছে।
২০১৪ সালে ক্রিমিয়া দখলের ঘটনা এবং ২০২১ সালে ইউক্রেন সীমান্তে রাশিয়ার সেনা সমাবেশের কথা উল্লেখ করে ইউরোপীয় ইউনিয়ন রাশিয়ার অভিপ্রায় নিয়ে গভীর সন্দেহ প্রকাশ করেছে।
তারা মনে করে, রাশিয়ার দেওয়া শান্তির শর্তের ওপর বিশ্বাস করা কঠিন।
যুক্তরাজ্যসহ অন্যান্য মিত্রদের সঙ্গে মিলে কিছু ইউরোপীয় দেশ ভবিষ্যতে শান্তিরক্ষার জন্য একটি প্রতিরোধ বাহিনী গঠনের চেষ্টা করছে।
এছাড়া, যুক্তরাষ্ট্রের সমর্থন না পাওয়া সত্ত্বেও, ইউক্রেনের জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ নিরাপত্তা নিশ্চয়তা হলো একটি শক্তিশালী এবং সুসজ্জিত সেনাবাহিনী।
ইউরোপীয় কমিশন সম্প্রতি এক প্রতিরক্ষা পরিকল্পনা প্রকাশ করেছে, যেখানে ইউক্রেনের নিরাপত্তা চাহিদা পূরণের উপায় বর্ণনা করা হয়েছে।
এই পরিকল্পনার আওতায়, ইউক্রেনের প্রতিরক্ষা শিল্পকে শক্তিশালী করতে ইইউ তহবিল ব্যবহারের প্রস্তাব করা হয়েছে, যা অস্ত্র ও গোলাবারুদ উৎপাদন খরচ কমাবে এবং যুদ্ধক্ষেত্রে দ্রুত সরবরাহ নিশ্চিত করবে।
পরিকল্পনায় আরও বলা হয়েছে, ইউক্রেন বর্তমানে ইউরোপের প্রতিরক্ষার সম্মুখভাগে রয়েছে এবং এই যুদ্ধের ফলাফল আমাদের সম্মিলিত ভবিষ্যতের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
ইইউ’র কৌশলগত পরিকল্পনার প্রধান অংশ হলো ইউক্রেনকে বিমান প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা এবং ক্ষেপণাস্ত্র সরবরাহ করা, যার মধ্যে দূরপাল্লার নির্ভুল অস্ত্রের ব্যবস্থাও অন্তর্ভুক্ত।
দেশগুলো সম্মিলিতভাবে এই সরঞ্জাম কিনবে এবং ইউক্রেনকে তাদের নিজস্ব উৎপাদন ক্ষমতা বাড়াতে আর্থিক সহায়তা দেবে।
যুদ্ধক্ষেত্রে ড্রোন-এর গুরুত্ব বিবেচনায় নিয়ে ইইউ ইউক্রেনকে ড্রোন সরবরাহ করতে এবং নিজস্ব উৎপাদন ক্ষমতা বাড়াতে সহায়তা করবে।
এর অংশ হিসেবে ইউরোপীয় ও ইউক্রেনীয় শিল্প প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে যৌথ উদ্যোগের পরিকল্পনাও রয়েছে।
প্রতি বছর অন্তত ২০ লক্ষ আর্টিলারি শেল সরবরাহের পাশাপাশি, ইইউ বর্তমানে ইউক্রেনীয় সৈন্যদের প্রশিক্ষণ দেওয়ার কার্যক্রম অব্যাহত রেখেছে।
এখন পর্যন্ত ৭৫ হাজারের বেশি ইউক্রেনীয় সৈন্যকে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছে। বিনিময়ে, ইউরোপীয় সৈন্যরা ইউক্রেনের যুদ্ধক্ষেত্রের অভিজ্ঞতা থেকে শিক্ষা নেবে।
ইউক্রেন ইইউ’র মহাকাশ কর্মসূচিতেও অংশ নিতে পারবে, যা তাদের জন্য নেভিগেশন, নজরদারি এবং যোগাযোগের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ সুযোগ তৈরি করবে।
আর্থিকভাবে, ইউক্রেনকে এরই মধ্যে প্রায় ১৫ হাজার কোটি মার্কিন ডলার (বাংলাদেশি মুদ্রায় প্রায় ১৬ লক্ষ কোটি টাকার বেশি) সহায়তা দেওয়া হয়েছে।
এছাড়াও, দেশটি প্রতিরক্ষা খাতে স্বল্প সুদে ঋণ নিতে পারবে।
ইইউ এবং নরওয়ের মতো দেশগুলোও ১৫০ বিলিয়ন ইউরোর (বাংলাদেশি মুদ্রায় প্রায় ১৭ লক্ষ কোটি টাকার বেশি) একটি নতুন তহবিল থেকে এই সুবিধা পাবে।
তথ্য সূত্র: অ্যাসোসিয়েটেড প্রেস