বিশ্বজুড়ে হিমবাহ গলতে শুরু করায় আসন্ন খাদ্য ও জলের সংকট, সতর্ক করল জাতিসংঘ।
জাতিসংঘের এক নতুন সতর্কবার্তায় জানানো হয়েছে, দ্রুত হারে হিমবাহ (glaciers) গলতে থাকায় সারা বিশ্বে প্রায় ২০০ কোটি মানুষের খাদ্য ও জলের নিরাপত্তা চরম হুমকির মুখে পড়তে পারে। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে বিশ্বের বিভিন্ন অঞ্চলের পার্বত্য এলাকাগুলোতে হিমবাহ ও তুষারপাতের পরিমাণ উল্লেখযোগ্যভাবে হ্রাস পাচ্ছে, যার সরাসরি প্রভাব পড়বে সেচ-নির্ভর কৃষি ব্যবস্থার ওপর।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এই পরিস্থিতিতে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবে উন্নয়নশীল দেশগুলো, যেখানে ইতিমধ্যেই বিপুল সংখ্যক মানুষ খাদ্য নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছে। জাতিসংঘের তথ্য অনুসারে, বিশ্বের এক বিলিয়নের বেশি মানুষ পার্বত্য অঞ্চলে বসবাস করে। এদের মধ্যে উন্নয়নশীল দেশগুলোর অর্ধেকের বেশি মানুষ খাদ্য সংকটে আছে।
আবহাওয়াবিদ ও পরিবেশ বিজ্ঞানীরা বলছেন, হিমবাহগুলো মূলত প্রাকৃতিক জলের ভাণ্ডার হিসেবে কাজ করে। এগুলো গলে যাওয়া জল বিভিন্ন নদী তৈরি করে এবং কৃষি ও মানুষের জীবন ধারণের জন্য অপরিহার্য জল সরবরাহ করে। কিন্তু জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে যখন এই বরফ দ্রুত গলতে শুরু করে, তখন এর প্রভাব সুদূরপ্রসারী হয়। এর ফলে একদিকে যেমন জলের অভাব দেখা দেয়, তেমনি অন্যদিকে অতিরিক্ত জলপ্রবাহের কারণে বন্যা ও ভূমিধসের মতো প্রাকৃতিক দুর্যোগও বাড়ে।
আমরা যেখানেই বাস করি না কেন, কোনো না কোনোভাবে আমরা পাহাড় ও হিমবাহের ওপর নির্ভরশীল। কিন্তু এই প্রাকৃতিক জলের স্তম্ভগুলো এখন চরম বিপদের সম্মুখীন। অবিলম্বে পদক্ষেপ নেওয়া না হলে এর ফল হবে ভয়াবহ।”
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, শুধু জলবায়ু পরিবর্তনই নয়, হিমবাহের গলন আরও কিছু মারাত্মক সমস্যার সৃষ্টি করে। বরফ গলে যাওয়ার ফলে যে কালো মাটি উন্মোচিত হয়, তা সূর্যের তাপ বেশি শোষণ করে, যা সামগ্রিক জলবায়ু ব্যবস্থার ওপর বিরূপ প্রভাব ফেলে। এছাড়াও, বরফ গলার কারণে ভূমিধসের (avalanche) ঝুঁকিও বাড়ে।
সাম্প্রতিক বছরগুলোতে হিমবাহ গলনের হার অতীতের সব রেকর্ড ভেঙে দিয়েছে। বিশ্ব আবহাওয়া সংস্থার (World Meteorological Organization) তথ্য অনুযায়ী, গত তিন বছরে হিমবাহের ভর সবচেয়ে বেশি কমেছে, যা জলবায়ু পরিবর্তনের গুরুতর উদ্বেগের একটি কারণ। নরওয়ে, সুইডেন, এবং গ্রীষ্মমন্ডলীয় অঞ্চলের দেশগুলোতে এর প্রভাব ইতোমধ্যে দৃশ্যমান হয়েছে।
হিমবাহ গলার কারণে সৃষ্ট সংকট শুধু কিছু অঞ্চলের মধ্যে সীমাবদ্ধ নেই। যুক্তরাষ্ট্রের কলোরাডো নদীর অববাহিকা অঞ্চলে গত ২০ বছর ধরে খরা চলছে। ইউরোপের আল্পস এবং পিরিনিস পর্বতমালায়ও হিমবাহ প্রায় ৪০ শতাংশ হ্রাস পেয়েছে। পূর্ব আফ্রিকার কিছু অঞ্চলে এরই মধ্যে ৮০ শতাংশ পর্যন্ত হিমবাহ গলে গেছে।
পাহাড় আমাদের মিঠা পানির ৬০ শতাংশ সরবরাহ করে, অথচ এই অঞ্চলের মানুষজনই খাদ্য নিরাপত্তাহীনতার শিকার। আমাদের অবশ্যই এই অঞ্চলের মানুষের জীবনযাত্রার মান উন্নয়নে বিনিয়োগ করতে হবে।”,
হিমবাহ গলার এই সংকট বাংলাদেশের জন্যও উদ্বেগের কারণ। যদিও বাংলাদেশের সরাসরি কোনো হিমবাহ নেই, তবে বৈশ্বিক জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে এখানকার আবহাওয়ায় পরিবর্তন হচ্ছে। সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি, ঘূর্ণিঝড় ও বন্যার মতো প্রাকৃতিক দুর্যোগের সংখ্যা বৃদ্ধি, এবং খাদ্য উৎপাদন কমে যাওয়ার মতো সমস্যাগুলো বাংলাদেশের জন্য একটি অশনি সংকেত। তাই, বিশ্বজুড়ে জলবায়ু পরিবর্তনের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে আমাদেরও সক্রিয়ভাবে অংশ নেওয়া উচিত।
তথ্য সূত্র: দ্য গার্ডিয়ান