ট্রাম্প কি ইউক্রেনের পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলো চান? কিয়েভ কী বলছে?
যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ইউক্রেনকে তাদের পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলো (nuclear power plants) ওয়াশিংটনের হাতে তুলে দেওয়ার কথা বলেছিলেন। এমন সময় এই প্রস্তাব আসে যখন ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধ চলছে।
তবে ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কি (Volodymyr Zelenskyy) দ্রুত এই বিষয়ে তার অবস্থান পরিষ্কার করেন।
সম্প্রতি এক টেলিফোন আলাপে ট্রাম্প জেলেনস্কিকে পরামর্শ দেন, তাদের চারটি পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র রক্ষার সেরা উপায় হলো এগুলো যুক্তরাষ্ট্রের হাতে তুলে দেওয়া। ট্রাম্পের মতে, “ওই কেন্দ্রগুলোর মালিকানা আমেরিকার হাতে থাকলে, অবকাঠামোটির ভালো সুরক্ষা হবে।”
তিনি আরও যোগ করেন, “বিদ্যুৎ ও ইউটিলিটি ক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্রের অভিজ্ঞতা রয়েছে এবং তারা কেন্দ্রগুলো পরিচালনায় সাহায্য করতে পারে।”
কিন্তু জেলেনস্কি জানান, তারা কেবল একটি বিদ্যুৎ কেন্দ্র নিয়েই কথা বলেছেন, যেটি বর্তমানে রাশিয়ার দখলে রয়েছে। তিনি বুঝিয়েছেন জাপোরিঝিয়া পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রের (Zaporizhzhia plant) কথা, যা ইউরোপের বৃহত্তম পারমাণবিক কেন্দ্র এবং এক সময় ইউক্রেনের বিদ্যুতের এক-পঞ্চমাংশ উৎপাদন করত।
২০২২ সাল থেকে রাশিয়া এটি দখল করে রেখেছে এবং এর ছয়টি চুল্লীই বর্তমানে ‘শীতল অবস্থায়’ (cold shutdown) রয়েছে, যার ফলে বিদ্যুৎ উৎপাদন বন্ধ আছে এবং বিস্ফোরণের ঝুঁকিও কমেছে।
তবে কিয়েভ (Kyiv) জাপোরিঝিয়া কেন্দ্রটি যুক্তরাষ্ট্রের হাতে তুলে দিতে রাজি নয়। জেলেনস্কি নরওয়ে সফরে গিয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে বলেন, “যদি তারা (যুক্তরাষ্ট্র) রাশিয়া থেকে এটি নিতে চায়, বিনিয়োগ করতে চায়, আধুনিকায়ন করতে চায়, তবে সেটা ভিন্ন বিষয়।
কিন্তু মালিকানা পরিবর্তনের কোনো প্রশ্নই ওঠে না।”
অনেক ইউক্রেনীয় মনে করছেন, ট্রাম্পের এই প্রস্তাবের পর রাশিয়া সেখানে কোনো ধরনের নাশকতা চালাতে পারে কিনা। উদাহরণস্বরূপ, তারা নোভা কাখোভকা বাঁধের (Nova Kakhovka dam) ধ্বংসের কথা উল্লেখ করেন, যা ২০২৩ সালের জুনে ধ্বংস হয়ে গিয়েছিল।
এই বাঁধটি জাপোরিঝিয়া কেন্দ্রের জন্য গুরুত্বপূর্ণ জল সরবরাহ করত। কিয়েভ এই ঘটনার জন্য মস্কোকে দায়ী করে একে ‘যুদ্ধাপরাধ’ এবং ‘পরিবেশ ধ্বংস’ হিসেবে বর্ণনা করেছে।
ইউক্রেনের সশস্ত্র বাহিনীর ডেপুটি চিফ অফ জেনারেল স্টাফ ইগর রোমানেঙ্কো (Ihor Romanenko) আল জাজিরাকে জানান, ট্রাম্প ইউক্রেনের সামরিক ও আর্থিক দুর্বলতার সুযোগ নিচ্ছেন এবং ভবিষ্যতে কিয়েভ কেন্দ্রগুলো ফেরত পেতে যুক্তরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে মামলা করতে পারে।
তিনি বলেন, “আমাদের স্মৃতিশক্তি ভালো আছে। আমরা ইউক্রেনের সবকিছু মনে রাখি এবং যা আমাদের, তার জন্য লড়াই করব।”
তবে, জাপোরিঝিয়া কেন্দ্রের এক প্রাক্তন কর্মী রাশিয়ার সম্ভাব্য নাশকতার আশঙ্কাকে তেমন গুরুত্ব দিতে রাজি নন। তিনি জানান, “আমার মনে হয় না, রাশিয়া ইচ্ছাকৃতভাবে কেন্দ্রের ক্ষতি করবে, কারণ কেন্দ্রটি দর কষাকষির বিষয়।”
তিনি আরও যোগ করেন, “কেন্দ্রের অবস্থা যত ভালো হবে, তারা সেটি বিনিময়ে তত বেশি দাম পাবে।”
বর্তমানে, কেন্দ্রটিতে রাশিয়ার সঙ্গে সহযোগিতা করা কর্মীরা ট্রাম্পের প্রস্তাবে উদ্বিগ্ন। তবে যুক্তরাষ্ট্র কেন্দ্রটি পুনর্দখলের জন্য সামরিক শক্তি ব্যবহারের ঘোষণা না দেওয়ায় তারা কিছুটা স্বস্তি বোধ করছেন।
অন্যদিকে, রাশিয়ার পক্ষ থেকে কেন্দ্রটির নিরাপত্তা নিয়ে উদ্বেগের যথেষ্ট কারণ রয়েছে। জানা যায়, সেখানে নিরাপত্তা বিধি উপেক্ষা করে কিছু ঘটনা ঘটেছে।
যদি তাদের কোনো গাফিলতির কারণে চুল্লী বা ব্যবহৃত জ্বালানি সংরক্ষণে কোনো ক্ষতি হয়, তবে ‘ডার্টি’ (dirty) পারমাণবিক বোমার মতো বিস্ফোরণ হতে পারে, যা ইউক্রেন ও পূর্ব ইউরোপের কিছু অংশে তেজস্ক্রিয়তা ছড়িয়ে দিতে পারে।
২০২২ সালের আগে, ইউক্রেনের চারটি পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র দেশটির প্রায় অর্ধেক বিদ্যুতের চাহিদা মেটাতো। বিশেষ করে, দেশটির পূর্বাঞ্চলে কয়লা খনিগুলোর নিয়ন্ত্রণ হারানোর পর এই কেন্দ্রগুলোর গুরুত্ব আরও বেড়ে যায়।
বর্তমানে, রাশিয়ার ক্রমাগত বোমা হামলায় ইউক্রেনের জ্বালানি অবকাঠামো ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। সম্প্রতি, রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন (Vladimir Putin) তাদের আঘাত করা বন্ধ করতে রাজি হয়েছেন।
ট্রাম্পের এই প্রস্তাবের পরেই, যুক্তরাষ্ট্রের জ্বালানি সচিব ক্রিস রাইট (Chris Wright) জানান, তার বিভাগের কেন্দ্রগুলো পরিচালনার জন্য “প্রচুর কারিগরি দক্ষতা” রয়েছে। তবে তিনি মনে করেন না এর জন্য “সামরিক উপস্থিতির” প্রয়োজন।
আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষকরাও ইউক্রেনের পুরনো পারমাণবিক চুল্লীগুলো নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন। প্রাগভিত্তিক পরিবেশবাদী সংস্থা ব্যাংকওয়াচ (Bankwatch) তাদের ‘জombie reactor’ (জombie চুল্লী) হিসেবে উল্লেখ করে বন্ধ করার আহ্বান জানিয়েছে।
যদিও ইউক্রেনের পারমাণবিক শক্তি সংস্থা এনারগোatom (Energoatom)-এর প্রধান পেত্রো কোতিন (Petro Kotin) এই অভিযোগ অস্বীকার করেছেন।
এনারগোatom-এ দুর্নীতি নিয়েও অনেক অভিযোগ রয়েছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এখানে প্রায়ই অনিয়ম হয় এবং নিম্নমানের যন্ত্রাংশ কেনা হয়।
তথ্য সূত্র: আল জাজিরা।