ফ্লোরিডা কিসের পানিতে মাছের ‘পাক খাওয়া মৃত্যু’, বাংলাদেশের জন্য কী শিক্ষা?
যুক্তরাষ্ট্রের ফ্লোরিডা অঙ্গরাজ্যের উপকূলীয় এলাকা ফ্লোরিডা কিসে আবারও এক অদ্ভুত ঘটনার সাক্ষী হয়েছে। সেখানকার পানিতে মাছেরা এলোমেলোভাবে ঘুরতে ঘুরতে মারা যাচ্ছে। বিজ্ঞানীরা এই ঘটনার কারণ অনুসন্ধানে নেমেছেন এবং এর দীর্ঘমেয়াদী প্রভাব কী হতে পারে, তা জানার চেষ্টা করছেন।
২০২৩ সালের শেষের দিকে, মাছ এবং অন্যান্য জলজ প্রাণী, বিশেষ করে শাপলাপাতা মাছ (Smalltooth sawfish) -কে বৃত্তাকারে ঘুরতে এবং অস্বাভাবিকভাবে সাঁতরাকাটার দৃশ্য দেখা যায়। এমনকি, তারা তীরে এসেও মারা যেতে শুরু করে। এই অস্বাভাবিক ঘটনায় ৮০টিরও বেশি প্রজাতি, যেমন – স্ন্যাপার, ষাঁড় হাঙ্গর এবং গোলিয়াথ গ্রাউপার-এর মতো মাছ আক্রান্ত হয়েছে।
শাপলাপাতা মাছের মৃত্যু ছিল বিশেষভাবে উদ্বেগজনক, কারণ এই প্রজাতিটি বিলুপ্তির ঝুঁকিতে রয়েছে।
গবেষকরা পানি ও মাছের নমুনা পরীক্ষা করে দেখেছেন, ক্ষতিকর শৈবাল বা অ্যালগির কারণে নিঃসৃত একাধিক বিষাক্ত পদার্থের প্রভাবে মাছগুলোর এমন অবস্থা হয়েছে। ফ্লোরিডার মৎস্য ও বন্যপ্রাণী গবেষণা ইনস্টিটিউটের প্রোগ্রাম অ্যাডমিনিস্ট্রেটর থমাস ম্যাথিউস জানান, “গত বছর, আমরা প্রমাণ পেয়েছি যে ক্ষতিকর শৈবালের আধিক্য ছিল, যেখানে মাছগুলো ঘুরছিল।
যদিও, বিজ্ঞানীরা বলছেন, সম্প্রতি এই ঘটনাগুলো আগের তুলনায় কম এবং সীমিত এলাকায় ঘটছে। বিজ্ঞানীরা এখন নতুন করে আক্রান্ত মাছগুলোর মধ্যে আগের ঘটনার উপসর্গগুলো রয়েছে কিনা, তা খতিয়ে দেখছেন। ম্যাথিউস আরও জানান, “আশ্চর্যজনক বিষয় হলো, পানির শৈবালের মাত্রা আগের ঘটনার মতো ততটা বেশি নয়।
ডিসেম্বর ২০২৩ থেকে, ফ্লোরিডা ফিশ অ্যান্ড ওয়াইল্ডলাইফ কনজারভেশন কমিশন (FWC)-এর কাছে মাছের এই ধরনের অস্বাভাবিক আচরণের প্রায় ৫০০টির বেশি অভিযোগ জমা পড়েছে। শুধু ডিসেম্বর ২০২৪ থেকে এ পর্যন্ত ৪৪টি ঘটনার খবর পাওয়া গেছে।
এর মধ্যে ২২টি শাপলাপাতা মাছের ঘটনার প্রমাণ পাওয়া গেছে, যার মধ্যে ৬টির মৃত্যু নিশ্চিত করা হয়েছে।
গবেষকরা বলছেন, সম্ভবত *গ্যাম্বিয়ারডিস্কাস* (Gambierdiscus) নামক এক ধরনের শৈবাল থেকে নির্গত বিষাক্ত পদার্থ মাছের স্নায়ু কোষের আবরণীতে আক্রমণ করে। এই আবরণীকে ক্ষতিগ্রস্ত করলে মাছের স্বাভাবিক স্নায়ু সংকেত ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
ম্যাথিউস এর ব্যাখ্যা করে বলেন, “বিষয়টা অনেকটা তারের বাইরের প্লাস্টিকের আবরণের মতো। যখন এই আবরণ নষ্ট হয়ে যায়, তখন তারটি কাজ করে না।
এর ফলে মাছগুলো অস্বাভাবিক আচরণ করতে শুরু করে, যেমন – ঘুরতে থাকা বা ঝাঁকুনি দেওয়া।
তাহলে, কেন এমনটা হচ্ছে? বিজ্ঞানীরা বলছেন, এর কারণ এখনো নিশ্চিতভাবে জানা যায়নি। তবে ধারণা করা হচ্ছে, ২০২৩ সালের গ্রীষ্মের তীব্র তাপপ্রবাহের কারণে শৈবালের সংখ্যা বেড়ে গিয়েছিল, যা মাছের মৃত্যুর কারণ হয়।
বন্যপ্রাণী ও পরিবেশ বিষয়ক সংস্থা ‘বোনফিশ অ্যান্ড টার্পন ট্রাস্ট’-এর ফ্লোরিডা কিস ইনিশিয়েটিভের পরিচালক রস বৌসেক বলেন, “আমাদের পরিবেশের ওপর স্থানীয় চাপ এবং তাপপ্রবাহের মিলিত প্রভাবেই এমনটা ঘটেছে বলে আমি মনে করি।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, তাপমাত্রা বাড়ার সঙ্গে ক্ষতিকর শৈবালের বিস্তার বাড়ে। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে তাপপ্রবাহ আরও ঘন ঘন হতে পারে, তাই ভবিষ্যতে এমন ঘটনা প্রতিরোধের জন্য বিজ্ঞানীদের গবেষণা চালিয়ে যেতে হবে।
তবে, ফ্লোরিডার জন্য স্বস্তির বিষয় হলো, এই ঘটনার কারণে সেখানকার মৎস্য শিল্পে কোনো প্রভাব পড়েনি এবং মানুষের স্বাস্থ্য ঝুঁকিও দেখা যায়নি। বৌসেক বলেন, “সমুদ্র খাদ্য নিরাপদ আছে, এটা খুবই ভালো খবর। তা না হলে কিসের অর্থনীতিতে বড় ধরনের ক্ষতি হতো।
ম্যাথিউস জনসাধারণের প্রতি আহ্বান জানিয়ে বলেন, “মাছ মারা যাওয়ার ঘটনা সম্পর্কে আমাদের হটলাইনে খবর দিন। আপনাদের দেওয়া তথ্য এই ঘটনার তদন্তে আমাদের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
ফ্লোরিডার এই ঘটনা শাপলাপাতা মাছসহ সেখানকার অন্যান্য জলজ প্রাণীদের রক্ষার প্রয়োজনীয়তা আরও একবার সামনে নিয়ে এসেছে। বৌসেক বলেন, “ফ্লোরিডায় এই বিশাল আকারের সামুদ্রিক প্রাণীটি (শাপলাপাতা মাছ) থাকাটা আমাদের জন্য সৌভাগ্যের বিষয়। আমরা কোনোভাবেই এদের হারাতে পারি না।
বাংলাদেশের জন্য এই ঘটনাটি একটি গুরুত্বপূর্ণ সতর্কবার্তা। আমাদের দেশের নদ-নদী ও সমুদ্র উপকূলগুলোতেও বিভিন্ন ধরনের দূষণ এবং জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব বাড়ছে। বিশেষ করে সুন্দরবনের মতো গুরুত্বপূর্ণ ম্যানগ্রোভ বন এবং উপকূলীয় এলাকার জীববৈচিত্র্য রক্ষার জন্য আমাদের আরও সচেতন হতে হবে।
ফ্লোরিডার মতো, বাংলাদেশেও জলজ পরিবেশের ওপর নজরদারি বাড়ানো এবং ক্ষতিকর শৈবালের বিস্তার রোধ করার জন্য দ্রুত পদক্ষেপ নেওয়া প্রয়োজন। এছাড়া, স্থানীয় জনগণের সচেতনতা বৃদ্ধি এবং পরিবেশ সুরক্ষায় তাদের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা জরুরি।
তথ্য সূত্র: ন্যাশনাল জিওগ্রাফিক