ফ্রান্সের প্রকাশনা জগতে একচেটিয়া আধিপত্য বিস্তারের অভিযোগে সেখানকার বই দোকানগুলোতে বিদ্রোহের সুর উঠেছে। রক্ষণশীল ক্যাথলিক বিলিওনেয়ার ভিনসেন্ট বোলোরের মিডিয়া সাম্রাজ্যের বিরুদ্ধে এই প্রতিবাদ।
বোলোরের বিশাল সাংস্কৃতিক সাম্রাজ্যের মধ্যে টেলিভিশন, রেডিও, এবং ২০২৩ সাল থেকে ফ্রান্সের বৃহত্তম প্রকাশনা ও বিতরণ সংস্থা, হাশেত লিভ্রে’র মালিকানা অন্যতম।
বই বিক্রেতাদের আশঙ্কা, বোলোরের এই আগ্রাসী নিয়ন্ত্রণ গণতন্ত্রের জন্য হুমকিস্বরূপ। প্যারিসের একটি স্বাধীন বই দোকান ‘লে পিএদ আ তের’ এর মালিক থিবো উইলেমস বলেন, “বইয়ের গুরুত্ব রয়েছে।”
তিনি হাশেত লিভরের বইয়ের অর্ডার কমাচ্ছেন এবং সেগুলোর স্থান দোকানের নিচের তাকে রাখছেন।
বোলোরে ফ্রান্সে বিশেষভাবে পরিচিত তার মালিকানাধীন সি নিউজ চ্যানেলের জন্য। বামপন্থী রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা এই চ্যানেলটিকে কট্টর-ডানপন্থী রাজনৈতিক দলগুলোর মুখপাত্র হিসেবে অভিযুক্ত করে আসছেন।
তারা মনে করেন, এই চ্যানেল চরম ডানপন্থীদের উত্থানে সহায়তা করছে।
২০২২ সালে সিনেট শুনানিতে বোলোরে তার বিরুদ্ধে ওঠা রাজনৈতিক ও আদর্শগত হস্তক্ষেপের অভিযোগ অস্বীকার করেন। তিনি দাবি করেন, গণমাধ্যম অধিগ্রহণের পেছনে তার মূল উদ্দেশ্য ছিল আর্থিক এবং তার সাংস্কৃতিক সাম্রাজ্য ফরাসি সংস্কৃতির প্রসার ঘটানো।
তবে অনেক বই বিক্রেতার মতে, একটি বৃহৎ কর্পোরেট প্রতিষ্ঠানের হাতে সংস্কৃতির নিয়ন্ত্রণ চলে যাওয়া গণতন্ত্রের জন্য বিপদজনক। হাশেত লিভ্রে, যা একসময় লাগারদের গ্রুপের অংশ ছিল, ২০২৩ সালে বোলোরের বিভেন্ডি গ্রুপ এটি কিনে নেয়।
বর্তমানে এটি ফ্রান্সের এক নম্বর প্রকাশক এবং বই পরিবেশক। হাশেতের অধীনে রয়েছে অসংখ্য প্রকাশনা সংস্থা, যারা অ্যাস্টেরিক্স কমিকস, সাহিত্য, থ্রিলার, রাজনৈতিক নিবন্ধ, মंगा কমিকস এবং পাঠ্যপুস্তক প্রকাশ করে থাকে।
বই বিক্রেতাদের প্রতিবাদের পাশাপাশি, বামপন্থী বিভিন্ন গোষ্ঠী ‘বুকমার্ক বিদ্রোহ’ শুরু করেছে। তারা বাণিজ্যিক দোকানগুলোতে বইয়ের মধ্যে “হাশেত বয়কট করুন” লেখা বুকমার্ক লুকিয়ে রাখছে, যেখানে বোলোরের সাম্রাজ্যের বিস্তারিত তথ্য তুলে ধরা হচ্ছে।
এই বুকমার্কগুলো প্রায়ই হাশেতের প্রকাশ করা প্রাক্তন ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসনের স্মৃতিকথা এবং মারিন লে পেনের নেতৃত্বাধীন চরম-ডানপন্থী ন্যাশনাল র্যালির তরুণ প্রেসিডেন্ট জর্দন বার্দেলার লেখা “সে কু জ শেরশে” (যা আমি খুঁজছি) বইগুলোতে পাওয়া যাচ্ছে।
বার্দেলার বইটি এরই মধ্যে ১ লাখ ৫০ হাজারের বেশি কপি বিক্রি হয়েছে।
থিবো উইলেমস স্বীকার করেন, এমন একটি প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করা কঠিন, যা বিতরণ ব্যবস্থার সিংহভাগ নিয়ন্ত্রণ করে। তিনি বলেন, “আমরা বয়কট করতে চাই।
তবে হাশেতের বিশাল সংগ্রহ থাকার কারণে তা সম্ভব নয়।” তিনি আরও যোগ করেন, “একটি বয়কট আমাদের গ্রাহকদের ক্ষতি করবে, যারা এই লেখকদের বই পড়তে চান।
তাই আমরা আমাদের সাধ্যমত চেষ্টা করছি।
এর অংশ হিসেবে তারা কিছু নতুন বইয়ের অর্ডার দেওয়া বন্ধ করে দিয়েছেন অথবা কম সংখ্যক কপি এনে টেবিলের গুরুত্বপূর্ণ স্থান থেকে সরিয়ে রাখছেন।
লিয়ঁর ‘লা ভিরভোল্ট’ নামক একটি স্বাধীন বই দোকানের প্রতিনিধি মার্টিন বেডেলেম বলেন, “বইয়ের জগতে আমরা দীর্ঘদিন ধরে প্রকাশনা থেকে শুরু করে বিতরণ পর্যন্ত মালিকানার কেন্দ্রীভবন নিয়ে উদ্বিগ্ন।
ফ্রান্সের বর্তমান রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে তিনি মনে করেন, বই একটি “অস্ত্র” হয়ে উঠতে পারে।
নোবেলজয়ী ফরাসি ঔপন্যাসিক অ্যানি এরনক্স হাশেতের মাধ্যমে প্রকাশিত হতে অস্বীকার করেছেন।
হাশেত লিভরের কর্মীদের প্রতিনিধিত্বকারী একটি সংস্থা সম্প্রতি বোলোরের অন্যান্য গণমাধ্যম ও টিভিতে চরম ডানপন্থীদের প্রতি পক্ষপাতিত্বের অভিযোগ করেছে।
ফরাসি প্রকাশনা শিল্পের ইতিহাসবিদ এবং ভার্সাই-সেন্ট-কোয়েন্টিন-এন-ইভলিন্স বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক জ্যাঁ-ইভ মোলিয়ার বলেন, বোলোরের এই বিস্তার মিডিয়া সাম্রাজ্যের পাশাপাশি “একটি বিশাল প্রকাশনা সংস্থা” তৈরি করেছে।
তিনি এটিকে যুক্তরাষ্ট্রের মিডিয়া মুঘল রুপার্ট মার্ডকের বই প্রকাশনার প্রসারের সঙ্গে তুলনা করেছেন।
“আমি মনে করি, এটি মত প্রকাশের স্বাধীনতা, বহুত্ববাদ এবং গণতন্ত্রের জন্য ঝুঁকি তৈরি করতে পারে।”
তথ্য সূত্র: দ্য গার্ডিয়ান