শিরোনাম: ইস্তাম্বুলের ‘তুর্ক’ রেস্টুরেন্ট: এক শেফের হাত ধরে তুর্কি খাবারের নতুন সংজ্ঞা
ইস্তাম্বুলে অবস্থিত ‘তুর্ক’ (Turk) নামের একটি রেস্টুরেন্ট, যা তুরস্কের খাদ্যরসিকদের কাছে এখন বেশ পরিচিত। এই রেস্টুরেন্টটি দুটি মিশেলিন স্টার (Michelin Star) জয় করেছে, যা এর ব্যতিক্রমী খাদ্য পরিবেশনার স্বীকৃতিস্বরূপ।
শেফ ফাতিহ তুতাক (Fatih Tutak)-এর নেতৃত্বে এই রেস্টুরেন্টটি তুর্কি খাবারের ঐতিহ্যকে নতুন আঙ্গিকে উপস্থাপন করে।
ফাতিহ তুতাক-এর শৈশব কেটেছে মায়ের হাতের রান্না দেখে। তাই ছোটবেলা থেকেই তার খাবারের প্রতি আগ্রহ ছিল।
ব্যাংককে রান্নার অভিজ্ঞতা অর্জনের পর ২০১৯ সালে তিনি তুরস্ক ফিরে আসেন এবং নিজের দেশের খাদ্য নিয়ে নতুন করে কাজ শুরু করেন। তিনি বলেন, “আমি চেয়েছিলাম আমার দেশের খাবারকে নিজের মতো করে পরিবেশন করতে।”
শেফের এই পথচলার শুরুটা হয়েছিল মেনগেন শহরে একটি রন্ধন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে পড়াশোনার মাধ্যমে। এরপর তিনি তুরস্কের বিভিন্ন হোটেল ও রেস্টুরেন্টে কাজ করেন এবং অভিজ্ঞতা অর্জন করেন।
তিনি টোকিও-র নিহনরিওরি রিউজিন (Nihonryori RyuGin) এবং কোপেনহেগেন-এর নোমা (Noma)-এর মতো বিশ্ববিখ্যাত রেস্টুরেন্টেও কাজ করেছেন।
এছাড়াও বেইজিং, সিঙ্গাপুর এবং হংকং-এর বিভিন্ন রেস্টুরেন্টে কাজ করার অভিজ্ঞতা রয়েছে তার।
২০১৫ সালে তিনি ব্যাংককে ‘দ্য ডাইনিং রুম অফ দ্য হাউস অন সাথর্ন’ (The Dining Room of The House on Sathorn) খোলেন।
সেখানেই তিনি প্রথম তার সিগনেচার ডিশ ‘ফ্রম মাই মম’ তৈরি করেন, যা ঐতিহ্যবাহী তুর্কি মান্তি ডাম্পলিং-এর একটি নতুন সংস্করণ।
এই খাবারের খ্যাতি তাকে নিজের দেশের খাবার নিয়ে আরও গভীরে কাজ করতে উৎসাহিত করে।
তিনি বলেন, “আমি অনুভব করলাম, বিশ্বজুড়ে আমার অভিজ্ঞতা কাজে লাগিয়ে, নিজের শিকড়ের প্রতি অবিচল থেকে নতুন স্বাদের খাবার তৈরি করতে হবে।”
তুর্কি খাবারের উপাদান ও আঞ্চলিক সংস্কৃতি সম্পর্কে আরও ভালোভাবে জানতে, ফাতিহ তুরস্কের বিভিন্ন অঞ্চলে প্রায় ২৫০০ মাইলের বেশি ভ্রমণ করেছেন।
তিনি মনে করেন, “কিছু অর্থবহ তৈরি করতে হলে, নিজের শিকড়ে ফিরতে হয়। আর সে কারণেই ‘তুর্ক’-এর সাফল্য।”
তুর্কি খাবারের ওপর অটোমান এবং সেলজুক সাম্রাজ্যের প্রভাব রয়েছে। এছাড়াও ভূমধ্যসাগরীয়, বলকান, মধ্যপ্রাচ্য, মধ্য এশিয়া ও পূর্ব ইউরোপের সংস্কৃতিও এর সঙ্গে মিশেছে।
শেফ ফাতিহ জানান, “তুর্কি খাবার বহু সংস্কৃতির মিশ্রণ। আমরা মেনু তৈরি করার সময় প্রতিটি সংস্কৃতির উপাদানগুলি অন্তর্ভুক্ত করার চেষ্টা করি।”
তিনি আরও বলেন, আনাতোলিয়া অঞ্চলের খাবারে অটোমান সংস্কৃতির প্রভাব রয়েছে, যেখানে মসলার ব্যবহার বেশি।
কৃষ্ণ সাগর অঞ্চলে মাছের প্রাধান্য দেখা যায়, আর দক্ষিণ অঞ্চলে মাংস, বিশেষ করে ল্যাম্ব-এর ব্যবহার হয় বিভিন্ন কাবাব ও মেজ়ে (mezze) পদে।
‘তুর্ক’-এর প্রতিটি উপাদান শেফের অভিজ্ঞতা ও মূল্যবোধের প্রতিচ্ছবি।
স্ক্যান্ডিনেভিয়ান ও জাপানি সংস্কৃতি থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে তিনি ইন্টেরিয়র-এ ‘জাপানডি’ (Japandi) ডিজাইন ব্যবহার করেছেন, যেখানে পরিচ্ছন্নতা, কাঠ ও পাথরের ব্যবহার দেখা যায়।
তবে, মার্বেল ফ্লোরে অটোমান তারাচিহ্ন, তুর্কি বর্ণমালার অলঙ্করণ এবং তুর্কি শিল্পকলার কাজ—এগুলো এই রেস্টুরেন্টটিকে দিয়েছে নিজস্বতা।
‘তুর্ক’-এ খাবারের অভিজ্ঞতাকে তিনটি অংশে ভাগ করা হয়েছে।
প্রথমে, অতিথিদের ছোট আকারের খাবার, ককটেল এবং তুর্কি ওয়াইন পরিবেশন করা হয়। এরপর ডাইনিং রুমে মৌসুমি মেনু থেকে সুস্বাদু খাবার পরিবেশন করা হয়।
তৃতীয় অংশে, অতিথিরা রান্নাঘরে যান, যেখানে তারা রেস্টুরেন্টের রন্ধন দর্শন সম্পর্কে জানতে পারেন এবং ডেজার্ট বিভাগে মিষ্টিমুখ করেন।
ডাইনিং রুমে ফিরে আসার পর, অতিথিদের মেনু দেখানো হয়, যা তারা ইতিমধ্যে উপভোগ করেছেন।
শেফ ফাতিহ-এর মতে, ‘তুর্ক’-এর সবচেয়ে আকর্ষণীয় খাবার হলো ‘মসল ডলমা’ (Mussel Dolma)। এটি তুর্কি রাস্তার খাবারের একটি আধুনিক সংস্করণ।
এটি তৈরি করা হয় চাল দিয়ে স্টাফ করা ঝিনুক দিয়ে, যা দারুচিনি, লবঙ্গ, জিরা ও গোলমরিচ দিয়ে সুস্বাদু করা হয় এবং বিয়ারের মেয়োনেজের সঙ্গে পরিবেশন করা হয়।
এমনকি ঝিনুকের খোলসও খাওয়া যায়, যা স্কুইড কালি, তেঁতুল, কিশমিশ এবং ক্যারামেলাইজড পেঁয়াজ দিয়ে তৈরি করা হয়।
শেফের চূড়ান্ত লক্ষ্য হলো, বিশ্বজুড়ে তুর্কি খাবারের বৈচিত্র্য তুলে ধরা।
তিনি বলেন, “আমরা চাই, আমাদের খাবারের ভিন্নতা ও উপাদান সম্পর্কে অতিথিদের ধারণা দিতে। তারা সবসময় এর বৈচিত্র্য দেখে অবাক হন।
তারা আগে কখনো এভাবে তুর্কি খাবার দেখেননি।
ভবিষ্যতে ফাতিহ তুতাক নতুন প্রজন্মের তুর্কি শেফদের পরামর্শদাতা হতে চান এবং তাদের সৃজনশীলতাকে উৎসাহিত করার জন্য একটি ফাউন্ডেশন তৈরি করতে চান।
তিনি বলেন, “আমি একজন ভালো ছাত্র, দেশের বিভিন্ন প্রান্তে ভ্রমণ করে আমি সবসময় অন্যদের কাছ থেকে শিখি।
ভালো শিক্ষক হওয়ার আগে ভালো ছাত্র হওয়া জরুরি।
তথ্য সূত্র: ন্যাশনাল জিওগ্রাফিক