চীনের একজন ৬৬ বছর বয়সী বৃদ্ধা লি ডংজু, যিনি সাইকেলে বিশ্ব ভ্রমণ করে সবার কাছে এক অনুপ্রেরণা জুগিয়েছেন। তার এই অসাধারণ যাত্রা শুরু হয় জীবনের কঠিন এক সময়ে, যখন তিনি বিবাহবিচ্ছেদের পর গভীর হতাশায় নিমজ্জিত ছিলেন।
সেই হতাশা থেকে মুক্তি পেতে তিনি বেছে নেন এক ভিন্ন পথ—সাইকেলে বিশ্বভ্রমণ।
চীনের হেনান প্রদেশের ঝেংঝো শহরের বাসিন্দা লি’র বয়স যখন ৫৬ বছর, তখন তিনি প্রথম আন্তর্জাতিক ভ্রমণে পা রাখেন। এরপর তিনি একা সাইকেল চালিয়ে ১২টি দেশ ঘুরেছেন, যার মধ্যে রয়েছে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া, ইউরোপ এবং ওশেনিয়ার বিভিন্ন দেশ।
কম্বোডিয়া, ফ্রান্স এবং অস্ট্রেলিয়ার মতো দেশগুলোতে তিনি ভ্রমণ করেছেন।
লি’র এই ভ্রমণের পথে সবচেয়ে বড় বাধা ছিল ভাষার ভিন্নতা। তিনি শুধুমাত্র ম্যান্ডারিন ভাষায় কথা বলতে পারতেন।
স্থানীয়দের সঙ্গে যোগাযোগের জন্য তিনি অনুবাদ অ্যাপের উপর নির্ভর করতেন। স্বল্প বাজেট এবং একাকীত্বের মাঝেও তিনি ভ্রমণের আনন্দ খুঁজে পেয়েছেন।
ভ্রমণের সময় লি পার্ক, পেট্রোল পাম্প এমনকি কবরস্থানেও রাত কাটিয়েছেন। তবে তিনি জানান, অনেক স্থানীয় মানুষ তাকে তাদের বাড়িতে আশ্রয় দিয়েছেন এবং সাহায্য করেছেন।
যা সত্যিই প্রশংসার যোগ্য।
২০২২ সালের শুরুতে কোভিড-১৯ মহামারীর কারণে লি’র এই যাত্রা কিছুদিনের জন্য থেমে যায়। তবে তিনি মনে করেন, সাইকেল ভ্রমণের অভিজ্ঞতা তার জীবনকে সম্পূর্ণ বদলে দিয়েছে।
তিনি বিশ্বাস করেন, ২০০৫ সালে বিবাহবিচ্ছেদের পর যে হতাশা তাকে গ্রাস করেছিল, তা থেকে মুক্তি দিয়েছে এই ভ্রমণ। লি বলেন, “আগে আমি অন্যদের উপর নির্ভরশীল ছিলাম… নিজেকে একটি কূপের মধ্যে আবদ্ধ ব্যাঙের মতো মনে হতো।
এখন আমি স্বাধীন, নির্ভীক এবং আত্মনির্ভরশীল একজন বুনো নেকড়ের মতো।”
চাকরি থেকে অবসর নেওয়ার পর লি’র হাতে তেমন কোনো অর্থ ছিল না। তিনি মাসে প্রায় ৩,০০০ ইউয়ান (বর্তমান বিনিময় হার অনুযায়ী যা প্রায় ৪২,০০০ টাকার মতো) পেনশন পেতেন।
সাইকেল কেনার মতো যথেষ্ট টাকাও তার কাছে ছিল না। প্রথমে তিনি একটি হেলমেট কেনেন, পরে তার ছেলে তাকে একটি ভাঁজ করা মাউন্টেন বাইক উপহার দেন, যার দাম ছিল প্রায় ১,০০০ ইউয়ান।
এরপর লি তার দুই বন্ধুর সঙ্গে মিলে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার উদ্দেশ্যে যাত্রা করেন। তবে সেখানে কিছু সমস্যার কারণে তিনি তার সঙ্গীদের থেকে আলাদা হয়ে যান এবং একা ভ্রমণ করতে শুরু করেন।
এরপর তিনি এক চীনা সাইকেল আরোহীর সঙ্গে পরিচিত হন, যিনি তাকে দেশে ফিরতে সাহায্য করেন।
২০১৫ সালে লি চীনের ২০টি শহরে সাইকেল চালান। তার সঙ্গী ছিল তার পোষা কুকুর শিলি। ২০১৩ সালে সাইকেল আরোহীদের একটি দল তার পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় তাদের দেখে লি’র মনে ভ্রমণের আগ্রহ জন্মায়।
এরপর তিনি সাইকেল চালানো শুরু করেন এবং ধীরে ধীরে বিশ্ব ভ্রমণের স্বপ্ন দেখতে শুরু করেন।
২০১৯ সালে লি ইউরোপের ৬টি দেশ ভ্রমণ করেন। এরপর তিনি অস্ট্রেলিয়া যান।
সেখানে তিনি দাবানলের কারণে ক্ষতিগ্রস্ত বন ও অন্যান্য দৃশ্য দেখেন। তিনি স্থানীয় পুলিশকে সতর্ক করে একটি বড় অগ্নিকাণ্ড থেকে রক্ষা করেন।
লি’র এই ভ্রমণের অভিজ্ঞতা নিঃসন্দেহে অন্যদের জন্য এক দারুণ উদাহরণ। তিনি প্রমাণ করেছেন, বয়স কোনো বাধা নয়, ইচ্ছাশক্তি থাকলে যেকোনো কিছুই জয় করা সম্ভব।
বর্তমানে তিনি কাজাখস্তান থেকে সংযুক্ত আরব আমিরাত পর্যন্ত ভ্রমণের পরিকল্পনা করছেন। তার লক্ষ্য, অন্তত ১০০টি দেশ ভ্রমণ করা।
লি’র ভাষায়, “ভ্রমণ একটি নেশার মতো। একবার স্বাদ পেলে, আপনি আর থামতে পারবেন না।”
তথ্য সূত্র: সিএনএন