রমজান মাসে ফিলিস্তিনের উদ্বাস্তু ও অভাবগ্রস্ত মানুষের পাশে দাঁড়াচ্ছে ‘সিদি শায়বান’ নামের একটি কমিউনিটি কিচেন। পশ্চিম তীরে ইসরায়েলি নিষেধাজ্ঞার মধ্যে এই মানবিক উদ্যোগ সেখানকার মানুষের জন্য এক টুকরো আশ্রয় হয়ে দাঁড়িয়েছে।
আল-জাজিরার একটি প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০০২ সাল থেকে আহমেদ আবু আল-আম এই কিচেনটি পরিচালনা করছেন, যেখানে রমজান মাস জুড়ে ইফতারের আয়োজন করা হয়।
ফিলিস্তিনের এল-বিরেহ এলাকার একটি হোটেলে, গাজ থেকে আসা প্রায় একশ জন বাস্তুচ্যুত মানুষ, যাদের অধিকাংশই চিকিৎসার জন্য এসেছেন, প্রতিদিন সূর্যাস্তের জন্য অপেক্ষা করেন। তাদের চোখেমুখে গভীর কষ্টের ছাপ, কারো হয়তো অঙ্গহানি হয়েছে, কারো বা প্রিয়জন হারানোর বেদনা।
এই মানুষগুলোর জন্য খাবার পরিবেশন করেন আবু আল-আম এবং তার স্বেচ্ছাসেবকরা।
খাবার বিতরণের সময় আবু আল-আম সব সময়ই চিন্তিত থাকেন, পর্যাপ্ত খাবার সরবরাহ করা যাচ্ছে কিনা। তিনি বলেন, “আমরা আমাদের সাধ্যমতো চেষ্টা করি। তবে সাহায্যদাতাদের নিজস্ব কিছু বিষয় থাকে, তাই আমরা যা পাই, তাই বিতরণ করি।”
এই উদ্বাস্তুদের মধ্যে রয়েছেন ৩৬ বছর বয়সী হায়া নাহাল। তিনি তার ১১ বছর বয়সী মেয়ে রাগদকে নিয়ে যুদ্ধের দুই মাস আগে রামাল্লায় এসেছিলেন। রাগদের স্নায়বিক সমস্যা রয়েছে।
মেয়ের চিকিৎসার জন্য স্বামীকে ও ছেলেকে ফেলে আসতে হয়েছে তাকে। হায়া বলেন, “এরপর আর ফেরা হয়নি। বাড়ির জীবন যতই কঠিন হোক না কেন, আপনজনের সান্নিধ্যের বিকল্প কিছু নেই। এখানে আশ্রয় আছে, ভালো মানুষজন সাহায্য করেন, কিন্তু এটা তো আর নিজের বাড়ি নয়।”
লায়লা নামের এক বৃদ্ধা গাজা থেকে এসেছেন, তার নাতনী আমিরাকে নিয়ে। আমিরা ক্যান্সারে আক্রান্ত হওয়ায় তিনি তাকে নিয়ে পূর্ব জেরুজালেমের একটি হাসপাতালে ভর্তি হয়েছিলেন।
লায়লার কথায়, “আমরা যুদ্ধ শুরুর ছয় মাস আগে এখানে আসি। আমিরাকে সঙ্গ দেওয়ার জন্য পরিবারের অন্য কাউকে আসতে দেওয়া হয়নি, তাই আমি এসেছিলাম।”
দুর্ভাগ্যজনকভাবে, আমিরা নভেম্বরে মারা যায়। নাতনীকে হারিয়ে লায়লা আজও গাজায় ফিরতে পারেননি। তিনি বলেন, “প্রায় দু’বছর ধরে এখানে আছি। গাজার জন্য মন কাঁদে।”
ইফতারের সময় হলে, সবাই নীরবে বসে যায় এবং কৃতজ্ঞতা ভরে প্রথম গ্রাসটি গ্রহণ করে। আবু আল-আম ও তার দল সবসময় সবার শেষে খাবার খান, নিশ্চিত করেন যেন কেউ অভুক্ত না থাকে।
আবু আল-আমের রান্নাঘরের পরিধি এখন অনেক বড়। একটি সাধারণ বাড়ি থেকে এটি এখন বিশাল একটি আশ্রয়কেন্দ্রে পরিণত হয়েছে। এখানে রান্নার জন্য বড় বড় চুলা ব্যবহার করা হয়।
রান্নার সুগন্ধ আশেপাশে ছড়িয়ে পড়লে পথচারীরাও আকৃষ্ট হয়।
স্বেচ্ছাসেবকরা তাদের দক্ষতার সাথে খাবার তৈরি করেন। মেন্যুতে থাকে কুদারা নামের একটি বিশেষ ফিলিস্তিনি খাবার, যা চাল, ছোলা, রসুন এবং মাংস দিয়ে তৈরি করা হয়। এছাড়াও থাকে মুরগির মাংস।
আবু আল-আম জানান, দ্বিতীয় ইন্তিফাদার সময় এই রান্নাঘরের ধারণা আসে। ইসরায়েলি অবরোধের কারণে যখন অনেক পরিবার কঠিন পরিস্থিতির শিকার হয়েছিল, তখন তাদের সাহায্য করার জন্য এই উদ্যোগ নেওয়া হয়। এরপর ধীরে ধীরে এই কার্যক্রম বৃদ্ধি পেতে থাকে।
২০১৫ সালে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে পরিচিতি পাওয়ার পর এটির নামকরণ করা হয় ‘সিদি শায়বান’, যিনি একসময় ক্রুসেডারদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেছিলেন।
বর্তমানে, ইসরায়েলের সহিংসতা ও নিষেধাজ্ঞার কারণে পরিস্থিতি আরও কঠিন হয়ে পড়েছে। শুধু এল-বিরেহ নয়, অনেক এলাকাতেই উদ্বাস্তু বেড়েছে।
আবু আল-আম জানান, তাদের লক্ষ্য হল— যত বেশি সম্ভব পরিবারের কাছে সহায়তা পৌঁছে দেওয়া। তিনি বলেন, “আমরা গাজাসহ অনেক অঞ্চলে সাহায্য পৌঁছে দিয়েছি। এখানে কেউ বাদ যায় না।”
আবু আল-আম আরও জানান, এই কার্যক্রম সম্পূর্ণভাবে অনুদান দ্বারা পরিচালিত হয়। কোভিড মহামারীর পর থেকে এখানকার চাহিদা বেড়েছে।
এরপর গাজায় ইসরায়েলের যুদ্ধ এবং পশ্চিম তীরে কঠোর বিধিনিষেধের কারণে অনেক পরিবার তাদের উপার্জন হারিয়েছে।
এই কিচেনের স্বেচ্ছাসেবকদের মধ্যে একজন হলেন শিরিন। তিনি জানান, “আমি পাঁচ বছর ধরে একা মা হিসেবে জীবন যাপন করছি। এই কিচেন যে এমনভাবে সাহায্য করতে পারে, তা আগে জানতাম না। এখন আমি তাদের হয়ে খাবার তৈরি করি এবং পরিচ্ছন্নতার কাজে সাহায্য করি, আর আমার সন্তানেরা আবু আল-আমের সাথে খাবার বিতরণের কাজ করে, বিশেষ করে রমজানে।”
১৪ বছর বয়সী মুস্তাফা এখানকার সবচেয়ে কনিষ্ঠ স্বেচ্ছাসেবক। সে জানায়, “আমি এখানে এসেছি, কারণ আমি এতিম এবং অন্যদের খুশি করতে চাই। স্বেচ্ছাসেবক হিসেবে কাজ করার কারণে আমার অনেক পরিবর্তন হয়েছে।”
তথ্য সূত্র: আল জাজিরা