বিশ্বযুদ্ধ-পরবর্তী সময়ে আন্তর্জাতিক সম্পর্কের স্থিতিশীলতাকে দুর্বল করে দিচ্ছে কিছু দেশের আগ্রাসী মনোভাব। বিশেষজ্ঞদের মতে, ডোনাল্ড ট্রাম্পের নেতৃত্বে যুক্তরাষ্ট্রের কিছু পদক্ষেপ, বিশেষ করে গ্রিনল্যান্ড, কানাডা, পানামা খাল এবং গাজা দখলের ইঙ্গিত আন্তর্জাতিক নিয়ম-নীতির পরিপন্থী।
এর ফলে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর থেকে তৈরি হওয়া সীমান্ত সংক্রান্ত ধারণাগুলো নতুন করে প্রশ্নের মুখে পড়ছে।
জাতিসংঘের ১৯৪৫ সালের সনদ অনুযায়ী, কোনো রাষ্ট্র অন্য রাষ্ট্রের স্বাধীনতা বা সার্বভৌমত্বের উপর আঘাত হানতে পারবে না।
কিন্তু ট্রাম্পের এমন মনোভাবের কারণে অনেক দেশই এখন নিজেদের প্রভাব বিস্তারের চেষ্টা করছে। উদাহরণস্বরূপ, রুয়ান্ডার প্রেসিডেন্ট পল কাগামের সমর্থনে কঙ্গোর বিদ্রোহী গোষ্ঠী এম২৩-এর কার্যকলাপ, ইসরায়েলের পশ্চিম তীর দখলের আগ্রাসী প্রচেষ্টা এবং চীনের তাইওয়ানকে নিজেদের অংশ হিসেবে দাবি করা ইত্যাদি বিষয়গুলো আন্তর্জাতিক অঙ্গনে উদ্বেগের সৃষ্টি করেছে।
বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, ট্রাম্পের এই সাম্রাজ্যবাদী দৃষ্টিভঙ্গি আন্তর্জাতিক সম্পর্ককে আরও জটিল করে তুলছে।
এমনকি অনেকে বলছেন, ট্রাম্পের আমলে নিয়ম-ভিত্তিক আন্তর্জাতিক ব্যবস্থা আর আগের মতো নেই। তারা মনে করেন, ট্রাম্পের বাণিজ্য নীতি এবং ভূমি দখলের প্রবণতা ১৯ শতকের মার্কিন প্রেসিডেন্ট উইলিয়াম ম্যাককিনলের সময়কে মনে করিয়ে দেয়, যিনি কিউবা, ফিলিপাইন, পুয়ের্তো রিকো এবং হাওয়াইকে যুক্তরাষ্ট্রের অন্তর্ভুক্ত করেছিলেন।
কানাডার প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডো সরাসরি অভিযোগ করেছেন যে, ট্রাম্প শুল্ক আরোপের মাধ্যমে কানাডার অর্থনীতিকে দুর্বল করে দেশটিকে নিজেদের সঙ্গে যুক্ত করতে চাইছেন।
শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক মাইকেল অ্যালবার্টাস মনে করেন, ট্রাম্পের এমন পদক্ষেপের ফলে অন্যান্য দেশগুলোও উৎসাহিত হচ্ছে এবং তারা তাদের প্রভাব বিস্তারের চেষ্টা করছে।
অন্যদিকে, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশ্লেষকদের মতে, প্রযুক্তি, জলবায়ু পরিবর্তন এবং খনিজ সম্পদের চাহিদার কারণেও এমনটা হচ্ছে।
ট্রাম্পের গ্রিনল্যান্ড দখলের আগ্রহ এবং রুয়ান্ডার ডিআরসিতে (DRC) প্রভাব বিস্তারের চেষ্টা তারই প্রমাণ।
রাজনৈতিক বিশ্লেষক এবং চ্যাথাম হাউজের বিশেষজ্ঞ সমীর পুরীর মতে, বর্তমান পরিস্থিতি কেবল দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ-পরবর্তী নয়, বরং শীতল যুদ্ধের অবসানের পর আন্তর্জাতিক ক্ষমতার ভারসাম্যের একটি নতুন চিত্র।
তিনি মনে করেন, ট্রাম্পের পররাষ্ট্রনীতি কোনো বিচ্ছিন্নতাবাদী নীতি নয়, বরং সাম্রাজ্যবাদী মনোভাবাপন্ন।
তবে, বিশ্লেষকরা সতর্ক করে বলছেন, ট্রাম্পের এই ধরনের পদক্ষেপ আন্তর্জাতিক স্থিতিশীলতার জন্য উদ্বেগের কারণ হতে পারে।
ট্রাম্পের নীতিগুলো দুর্বল দেশগুলোকে তাদের স্বাধীনতা এবং সার্বভৌমত্ব রক্ষার ক্ষেত্রে আরও কঠিন পরিস্থিতির দিকে ঠেলে দিতে পারে।
অধ্যাপক মাইকেল বেকার মনে করেন, ট্রাম্পের ইউক্রেনকে সমর্থন না করা এবং গাজাকে দখলের ইঙ্গিত দেওয়া, ইসরায়েলকে আন্তর্জাতিক আইন ভাঙার সুযোগ করে দিচ্ছে এবং যা সহিংসতার একটি দীর্ঘ চক্র তৈরি করতে পারে।
আন্তর্জাতিক নিরাপত্তা বিষয়ক অধ্যাপক কেরি গোয়েটলিখ মনে করেন, যুক্তরাষ্ট্রের এমন পরিবর্তন একটি ঐতিহাসিক পরিবর্তনের ইঙ্গিত দেয়।
ঐতিহাসিক বিশ্লেষক কাল রাউস্টিয়ালা মনে করেন, ম্যাককিনলের সাম্রাজ্যবাদী নীতিগুলো বেশ সমস্যা তৈরি করেছিল।
অধ্যাপক তানিশা ফাজাল-এর মতে, ভূমি দখল গণতন্ত্রের পরিপন্থী এবং আন্তর্জাতিক সম্পর্কের অনেক নিয়ম এক্ষেত্রে টিকতে পারে না।
তথ্যসূত্র: The Guardian