জাপানের রাজধানী টোকিওর একটি আদালত বিতর্কিত ‘ইউনিফিকেশন চার্চ’ ভেঙে দেওয়ার নির্দেশ দিয়েছে। এই সিদ্ধান্তটি এসেছে প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী শিনজো আবের হত্যাকাণ্ডের তদন্তের ফলস্বরূপ, যা জাপানে ব্যাপক আলোড়ন সৃষ্টি করেছিল।
আদালত এই চার্চের বিরুদ্ধে তাদের অনুসারীদের কাছ থেকে প্রতারণামূলক উপায়ে বিপুল পরিমাণ অর্থ আদায়ের অভিযোগ এনেছে। এছাড়াও, সদস্যদের মধ্যে শিশুদের প্রতি অবহেলার অভিযোগও রয়েছে।
ইউনিফিকেশন চার্চ, যা সাধারণত ‘মুনিজ’ নামে পরিচিত, দক্ষিণ কোরিয়াতে জন্ম নেয় এবং এর প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন সান মিয়ুং মুন। এই চার্চের বিরুদ্ধে অভিযোগ, তারা তাদের সদস্যদের কাছ থেকে এমন সব অনুদান আদায় করত যা তাদের জীবনযাত্রাকে কঠিন করে তুলত।
এমনকি অনেক পরিবার এতে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে এবং শিশুদের প্রতিও চরম অবহেলা করা হয়েছে। যদিও চার্চ কর্তৃপক্ষ তাদের বিরুদ্ধে আনা এই অভিযোগগুলো অস্বীকার করেছে এবং আদালতের এই সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে আপিল করার কথা বিবেচনা করছে।
জাপানের শিক্ষা মন্ত্রণালয় ২০২৩ সালে এই প্রভাবশালী ধর্মীয় গোষ্ঠীকে ভেঙে দেওয়ার আবেদন জানিয়েছিল। তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ ছিল, তারা তাদের অনুসারীদের মধ্যে ভীতি তৈরি করে এবং তাদের কাছ থেকে অর্থ আদায়ের জন্য বিভিন্ন কৌশল অবলম্বন করত।
এর ফলে অনেক পরিবার ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।
আদালতের এই সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিক্রিয়া জানিয়েছে ইউনিফিকেশন চার্চ। তারা এটিকে “অন্যায় এবং দুঃখজনক” বলে অভিহিত করেছে।
তাদের মতে, আদালতের এই রায় “ভুল আইনগত ব্যাখ্যার” উপর ভিত্তি করে দেওয়া হয়েছে।
শিনজো আবের হত্যাকাণ্ড-সংক্রান্ত তদন্তে এই চার্চের সঙ্গে জাপানের ক্ষমতাসীন লিবারেল ডেমোক্রেটিক পার্টির দীর্ঘদিনের সম্পর্কের বিষয়টিও প্রকাশ হয়। ১৯৬০-এর দশকে, যখন জাপানে কমিউনিস্ট বিরোধী আন্দোলন চলছিল, সেই সময় আবে’র দাদা, প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী নবুসুকে কিশির সমর্থন লাভ করে এই চার্চ।
আবে’কে হত্যা করার অভিযোগে অভিযুক্ত ব্যক্তি, এই চার্চের প্রতি তীব্র ঘৃণা পোষণ করতেন এবং তাঁর পরিবারের আর্থিক দুরবস্থার জন্য চার্চকে দায়ী করতেন।
ইউনিফিকেশন চার্চ আনুষ্ঠানিকভাবে ‘ফ্যামিলি ফেডারেশন ফর ওয়ার্ল্ড পিস অ্যান্ড ইউনিফিকেশন’ নামে পরিচিত। জাপানের দেওয়ানি আইনের অধীনে কোনো ধর্মীয় গোষ্ঠীকে ভেঙে দেওয়ার এই ঘটনা সম্ভবত প্রথম।
এর আগে, সন্ত্রাসী কার্যক্রমের সঙ্গে জড়িত থাকার অভিযোগে ‘আউম শিনরিকেও’ এবং প্রতারণার দায়ে ‘মিওকাকুজি’র মতো কয়েকটি গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছিল।
শিক্ষা মন্ত্রণালয়, চার্চ ভেঙে দেওয়ার জন্য আদালতে ৫,০০০ এর বেশি নথি ও প্রমাণ জমা দেয়, যা ১৭০ জনের বেশি মানুষের সাক্ষ্যের ভিত্তিতে তৈরি করা হয়েছিল।
আদালতের অনুসন্ধানে জানা যায়, এই চার্চ তাদের অনুসারীদের কাছ থেকে উচ্চ মূল্যের জিনিসপত্র কিনতে এবং সাধ্যের অতিরিক্ত অর্থ দান করতে বাধ্য করত।
এই ধরনের কাজের ফলে অনেক মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে এবং তাদের মধ্যে ভীতি ছড়িয়ে পরেছিল।
জাপানের সংস্কৃতি বিষয়ক সংস্থা জানিয়েছে, আদালতের বাইরে এবং ভেতরে হওয়া সমঝোতার মাধ্যমে ক্ষতিপূরণ বাবদ প্রায় ২,০০০ কোটি ইয়েন (১,৪০০ কোটি টাকার বেশি) আদায় করা হয়েছে, যা ১,৫০০ জনের বেশি মানুষকে প্রভাবিত করেছে।
(এই হিসাবটি ১৯ই মে, ২০২৪ তারিখের মুদ্রা বিনিময় হার অনুযায়ী)।
ইউনিফিকেশন চার্চ ১৯৫৪ সালে সিউলে প্রতিষ্ঠিত হয়, যা কোরিয়া যুদ্ধের এক বছর পরের ঘটনা।
এর প্রতিষ্ঠাতা সান মিয়ুং মুন নিজেকে একজন মসিহা হিসেবে ঘোষণা করেছিলেন এবং বাইবেলের নতুন ব্যাখ্যা ও পরিবার-কেন্দ্রিক মূল্যবোধ প্রচার করতেন।
এই চার্চ একসময় যুক্তরাষ্ট্রের প্রাক্তন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প এবং তাঁর পূর্বসূরি রিচার্ড নিক্সন, রোনাল্ড রেগান ও জর্জ এইচ.ডব্লিউ. বুশের মতো প্রভাবশালী নেতাদের সঙ্গে সম্পর্ক গড়ে তুলেছিল।
১৯৭০ ও ১৯৮০-এর দশকে এই চার্চের বিরুদ্ধে তাদের অনুসারীদের মগজ ধোলাই করে বিপুল পরিমাণ অর্থ আদায়ের অভিযোগ উঠেছিল।
জাপানে, এই গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে ‘আধ্যাত্মিক পণ্য’ বিক্রির মাধ্যমে সদস্যদের কাছ থেকে অর্থ আদায়ের অভিযোগ রয়েছে, যার মাধ্যমে তারা মূল্যবান শিল্পকর্ম ও গয়না কিনতে বা চার্চের জন্য জমি বিক্রি করতে বাধ্য হতেন।
যদিও চার্চ অতিরিক্ত অর্থ আদায়ের কথা স্বীকার করেছে, তবে তাদের দাবি, ২০০৯ সাল থেকে তারা এই ধরনের কার্যকলাপ কমিয়ে দিয়েছে।
বিশেষজ্ঞদের মতে, জাপানের অনুসারীদের তাঁদের পূর্বপুরুষদের দ্বারা কোরীয় উপদ্বীপের ১৯১০-১৯৪৫ সাল পর্যন্ত জাপানি ঔপনিবেশিক শাসনের সময় করা পাপের জন্য অর্থ দিতে বলা হতো।
এছাড়া, এই চার্চের বিশ্বব্যাপী তহবিলের অধিকাংশই আসে জাপান থেকে।
তথ্য সূত্র: দ্য গার্ডিয়ান