দক্ষিণ কোরিয়ার একটি পুরনো ‘শিশু রপ্তানির’ গোপন কাহিনী, যা বিশ্বকে নাড়িয়ে দিয়েছে। দেশটির সরকার একসময় অর্থনৈতিক দুরবস্থার কারণে শিশুদের বিদেশে দত্তক দিতো।
কিন্তু সম্প্রতি একটি তদন্তে জানা গেছে, এই প্রক্রিয়ায় মানবাধিকারের চরম লঙ্ঘন করা হয়েছে। শিশুদের জন্ম বৃত্তান্ত জাল করা হয়েছে, এমনকি তাদের জন্মদাতাদের থেকে জোর করে আলাদা করা হয়েছে।
যুদ্ধবিধ্বস্ত কোরিয়া, যেখানে দারিদ্র্য ছিল নিত্যদিনের সঙ্গী, সেই ১৯৫০ এর দশক থেকে শিশুদের বিদেশে পাঠানোর এক বিশাল প্রক্রিয়া শুরু হয়। দুই লক্ষাধিক শিশুকে এভাবে বিভিন্ন দেশে দত্তক নেওয়া হয়েছিল।
বর্তমানে, এই সকল দত্তক নেওয়া শিশুদের অনেকেই তাদের শিকড়ের সন্ধানে ব্যাকুল হয়ে উঠেছে। তাদের অভিযোগ, দত্তক নেওয়ার প্রক্রিয়াটি ছিল প্রতারণামূলক এবং অনেক ক্ষেত্রে তাদের মায়েদের কাছ থেকে জোর করে শিশুদের আলাদা করা হয়েছে।
সরকারের ট্রুথ অ্যান্ড রিকনসিলিয়েশন কমিশন সম্প্রতি ৩৬৭টি অভিযোগের মধ্যে প্রাথমিকভাবে ১০০টির ওপর তদন্তের ফলাফল প্রকাশ করেছে। এই শিশুদের ১১টি ভিন্ন দেশে পাঠানো হয়েছিল।
তদন্তে দেখা গেছে, এই দত্তক প্রক্রিয়াগুলোতে ব্যাপক অনিয়ম ছিল। কমিশনের অনুসন্ধানে জানা যায়, অনেক ক্ষেত্রে শিশুদের পরিচয় গোপন করা হয়েছে এবং তাদের জন্মবৃত্তান্ত মিথ্যাভাবে উপস্থাপন করা হয়েছে।
এমনকি, শিশুদের ‘পরিত্যক্ত’ হিসেবে দেখিয়ে দত্তক দেওয়ার প্রমাণও মিলেছে।
কমিশনার লি সাং-হুন এক সংবাদ সম্মেলনে জানান, দত্তক সংস্থাগুলো মূলত অনুদানের উপর নির্ভরশীল ছিল। ফলে, তাদের কার্যক্রম টিকিয়ে রাখার জন্য শিশুদের বিদেশে পাঠানোর চাপ ছিল।
এই পরিস্থিতিতে অবৈধভাবে শিশুদের দত্তক দেওয়ার ঝুঁকি বেড়ে যায়। এছাড়াও, অভিভাবকদের পর্যাপ্ত যাচাই-বাছাই ছাড়াই শিশুদের তুলে দেওয়া হতো। শিশুদের দেখাশোনার ক্ষেত্রেও অভিভাবকদের চরম অবহেলা ছিল।
কমিশন একটি ঘটনার উল্লেখ করেছে, যেখানে এক নারী সন্তান জন্ম দেওয়ার পরপরই দত্তক গ্রহণের একটি ফরমে স্বাক্ষর করেন। একটি সংস্থা এরপর মায়ের পরিচয় যাচাই ছাড়াই শিশুটিকে তাদের হেফাজতে নেয়।
এই ধরনের ঘটনাগুলো দক্ষিণ কোরিয়ার তৎকালীন শিশু দত্তক প্রক্রিয়ার দুর্বলতাকেই তুলে ধরে।
তদন্তে উঠে আসা এসব তথ্য, কোরিয়ার সংবিধান এবং আন্তর্জাতিক আইনের পরিপন্থী ছিল। কমিশন এখন সরকারের কাছে আনুষ্ঠানিকভাবে ক্ষমা চাওয়া এবং ক্ষতিগ্রস্তদের ক্ষতিপূরণ দেওয়ার সুপারিশ করেছে।
একইসঙ্গে, দত্তক নেওয়া শিশুদের নাগরিকত্বের বিষয়ে একটি বিস্তারিত জরিপ করারও পরামর্শ দেওয়া হয়েছে।
ডেনমার্কে বেড়ে ওঠা হান বুন-ইয়ং নামের এক দত্তক নেওয়া ব্যক্তি বলেন, “আমরা অনেক দিন ধরে এই বিচারের অপেক্ষায় ছিলাম। অবশেষে আমরা একটা জয় পেয়েছি।”
যদিও তিনি নিজে ক্ষতিগ্রস্ত হিসেবে চিহ্নিত হননি, কারণ তার কাছে পর্যাপ্ত নথি ছিল না। মারিয়ানে ওক নীলসেন নামের আরেকজন, যিনি তার ফলাফলের জন্য অপেক্ষা করছেন, তিনি মনে করেন, এই ঘটনার শিকার অনেকেই তাদের অধিকার থেকে বঞ্চিত হয়েছেন।
যদিও বর্তমানে দক্ষিণ কোরিয়ায় দত্তক নেওয়ার সংখ্যা কমে এসেছে, কারণ দেশটি ইতিমধ্যে তাদের আইন পরিবর্তন করেছে। তবে, অতীতের এই ঘটনাগুলো দেশটির ইতিহাসে একটি কালো অধ্যায় হয়ে থাকবে।
তথ্য সূত্র: সিএনএন