বিখ্যাত সঙ্গীত শিল্পী জন লেনন এবং ইয়োকো ওনোর জীবন নিয়ে নির্মিত একটি নতুন তথ্যচিত্র মুক্তি পেতে যাচ্ছে, যা আলোচনায় এসেছে তাদের সম্পর্ক এবং রাজনৈতিক অস্থিরতা নিয়ে। ‘ওয়ান টু ওয়ান: জন অ্যান্ড ইয়োকো’ (One to One: John & Yoko) শিরোনামের এই ছবিতে সত্তরের দশকের শুরুতে নিউ ইয়র্কে তাদের জীবনের অজানা দিকগুলো তুলে ধরা হয়েছে। খবরটি আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম থেকে জানা গেছে।
১৯৭১ সালে, বিটলস ভেঙে যাওয়ার পর জন লেনন এবং ইয়োকো ওনো দুজনেই ইংল্যান্ড ছেড়ে নিউ ইয়র্কে পাড়ি জমান। সে সময় তারা দুজনেই ছিলেন অনিশ্চয়তার মধ্যে। একদিকে বিটলস ভাঙনের প্রতিক্রিয়া, অন্যদিকে ইয়োকোর প্রতি বর্ণবাদ ও বিদ্বেষ—সবকিছু থেকে মুক্তি পেতে চেয়েছিলেন তারা। একইসাথে, নিউ ইয়র্কের শিল্পকলার জগতে নতুন কিছু করার স্বপ্নও ছিল তাদের।
নির্মাতা কেভিন ম্যাকডোনাল্ডের (Kevin Macdonald) এই তথ্যচিত্রে মূলত ১৯৭২ সালের গ্রীষ্মে ম্যাডিসন স্কয়ার গার্ডেনে (Madison Square Garden) অনুষ্ঠিত ‘ওয়ান টু ওয়ান’ কনসার্টের (One to One concert) প্রেক্ষাপট তুলে ধরা হয়েছে, যা ছিল বিটলস ত্যাগের পর লেননের একমাত্র পূর্ণাঙ্গ কনসার্ট। ছবিতে শোনা যাবে, আগে কখনো শোনা যায়নি এমন অনেক টেলিফোন কথোপকথন, ব্যক্তিগত মুহূর্তের ভিডিও এবং অন্যান্য দুর্লভ চিত্র।
লেনন সেসময় বেশ কিছু প্রশ্ন নিয়ে গভীর চিন্তাভাবনা করতেন। ‘ফ্লাওয়ার পাওয়ার’ (flower power) কেন কাজ করল না? কেন তরুণ সমাজ এত উদাসীন? একজন প্রাক্তন বিটল হিসেবে কীভাবে তিনি বিশ্বকে আরও সুন্দর করতে পারেন? এই বিষয়গুলো তাকে ভাবাতো।
ইয়োকো ওনোর সাথে বিভিন্ন রাজনৈতিক সমাবেশে যোগ দেওয়া এবং ‘ইয়েপিস’ (Yippies – ইয়ুথ ইন্টারন্যাশনাল পার্টি)-এর মতো বিপ্লবী গোষ্ঠীর সঙ্গে কাজ করার মাধ্যমে লেনন নিজেকে একজন ‘ট্রাউবেডর’ (troubadour) হিসেবে দেখতে শুরু করেন। তিনি গানের মাধ্যমে সমাজের কথা বলতে চেয়েছিলেন। এমনকি, ভিয়েতনামে বেসামরিক নাগরিকদের ওপর বোমা হামলার প্রতিবাদে সহিংসতার ধারণাকেও সমর্থন করেছিলেন তিনি।
তথ্যচিত্রে লেননকে মাঝে মাঝে দ্বিধাগ্রস্ত মনে হয়। তিনি উত্তর খুঁজছিলেন, বিভিন্ন রূপে নিজেকে প্রকাশ করতে চাচ্ছিলেন। সেই সময়ে তার এই উন্মুক্ত মানসিকতা দর্শককে গভীরভাবে নাড়া দেয়।
ছবিটি নির্মাণের সময় নির্মাতারা লেনন পরিবারের কাছ থেকে অনুমোদন পান। লেননের ছেলে শন ওনো লেনন (Sean Ono Lennon), যিনি নিজেও একজন সঙ্গীতশিল্পী, এই সৃজনশীল প্রক্রিয়ার গুরুত্ব বোঝেন। শন জানান, তার মায়ের (ইয়োকো ওনো) এই ধরনের ছবি ভালো লাগবে।
ছবিতে ইয়োকো ওনোর জীবনের একটি বিশেষ দিক বিশেষভাবে ফুটে উঠেছে। ছবিতে দেখা যায়, তিনি তার মেয়ে কিয়োকোকে (Kyoko) দীর্ঘদিন কাছে পাননি। এই বেদনা তার মধ্যে গভীর প্রভাব ফেলেছিল, যা দর্শকদেরও ছুঁয়ে যায়।
লেনন এবং ওনো একবার স্টেটেন আইল্যান্ডে (Staten Island) অবস্থিত ‘উইলোব্রুক স্কুল’ (Willowbrook school)-এর শিশুদের দুরবস্থা দেখে গভীরভাবে মর্মাহত হন। এরপরই তারা এই শিশুদের সহায়তার জন্য ‘ওয়ান টু ওয়ান’ কনসার্টের আয়োজন করেন। তাদের এই উদ্যোগের মাধ্যমে তারা সমাজের পিছিয়ে পড়া শিশুদের জীবনে পরিবর্তন আনতে চেয়েছিলেন।
ছবিতে ব্যবহৃত হয়েছে লেনন ও ওনোর ব্যক্তিগত সংগ্রহ থেকে নেওয়া নানা ফুটেজ। এর মধ্যে ছিল সুপার এইট (Super 8) ফিল্মে ধারণ করা পারিবারিক দৃশ্য এবং তাদের তৈরি করা কিছু শিল্পকর্ম।
তথ্যচিত্রের কাজ যখন অর্ধেক সম্পন্ন হয়, তখন জানা যায়, নির্মাতারা সেই সময়ের কিছু দুর্লভ ফোন রেকর্ডিং খুঁজে পেয়েছেন। সেই কথোপকথনগুলো শুনে দর্শকদের মনে হবে, এই দুই কিংবদন্তী শিল্পী ব্যক্তিগত জীবনে কেমন ছিলেন।
তবে, এই ছবিতে লেনন ও ওনোর সম্পর্কের টানাপোড়েন সেভাবে দেখা যায় না। বরং তাদের গভীর ভালোবাসার চিত্র ফুটে ওঠে। তবে, বিভিন্ন সূত্রে জানা যায়, ১৯৭৩ সালে তাদের বিচ্ছেদ হয়, যার পেছনে পরোক্ষভাবে তৎকালীন মার্কিন প্রেসিডেন্ট রিচার্ড নিক্সনের (Richard Nixon) পুনর্নির্বাচন বড় ভূমিকা রেখেছিল। নিক্সনের এই বিজয়ে হতাশ হয়ে পড়েছিলেন লেনন। তাদের ধারণা ছিল, তারা জনমত পরিবর্তনে যে চেষ্টা করেছিলেন, তা ব্যর্থ হয়েছে।
রাজনৈতিক এই হতাশা থেকেই সম্ভবত লেনন ও ওনোর মধ্যে দূরত্ব তৈরি হয়।
তথ্যসূত্র: দ্য গার্ডিয়ান