ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচি: ওমানের মধ্যস্থতায় যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে আলোচনা
মধ্যপ্রাচ্যে যখন উত্তেজনা তুঙ্গে, তখন ইরানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী মঙ্গলবার জানিয়েছেন যে, তেহরানের দ্রুতগতিতে এগিয়ে চলা পারমাণবিক কর্মসূচিকে থামানোর লক্ষ্যে যুক্তরাষ্ট্রের বিশেষ দূতের সঙ্গে তিনি ওমানে আলোচনা করতে রাজি হয়েছেন। এই আলোচনা হতে যাচ্ছে ট্রাম্প প্রশাসনের অধীনে, তবে তা হবে পরোক্ষভাবে।
আলজেরিয়া থেকে ইরানের রাষ্ট্রীয় টেলিভিশনে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে আব্বাস আরাকচি জানান, এই আলোচনা সম্ভবত ওমানের মধ্যস্থতাকারীদের মাধ্যমে দুই পক্ষের মধ্যে অনুষ্ঠিত হবে। যদিও যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প সোমবার এই আলোচনার ঘোষণা দেওয়ার সময় একে সরাসরি আলোচনা হিসেবে উল্লেখ করেছিলেন।
বাইডেন প্রশাসনের অধীনে হওয়া আগের কয়েক বছরের পরোক্ষ আলোচনা কোনো ফল বয়ে আনতে পারেনি। বর্তমানে ইরান ৬০ শতাংশ পর্যন্ত ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধ করছে, যা অস্ত্র তৈরির জন্য প্রয়োজনীয় মাত্রার খুব কাছাকাছি। যুক্তরাষ্ট্র এবং ইসরায়েল উভয়ই ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচির কারণে সামরিক হামলার হুমকি দিয়েছে, অন্যদিকে তেহরানের কর্মকর্তারাও পারমাণবিক বোমা তৈরির সম্ভাবনার কথা শোনাচ্ছেন।
আরাকচি বলেন, “আলোচনার মূল উদ্দেশ্য হলো জনগণের অধিকার পুনরুদ্ধার এবং নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করা। অন্য পক্ষ যদি আন্তরিক হয়, তবে এটি সম্ভব। সরাসরি হোক বা পরোক্ষ, এতে কিছু যায় আসে না। আপাতত, আমাদের পছন্দ হলো পরোক্ষ আলোচনা এবং আমরা এতে কোনো পরিবর্তন আনতে চাই না।”
আরাকচির এই মন্তব্যের মাধ্যমে ভবিষ্যতে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে ইরানের সরাসরি আলোচনার সম্ভাবনাও খোলা রয়েছে। ওবামা প্রশাসনের পর এমন কোনো সরাসরি আলোচনা হয়নি।
এদিকে, যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষ থেকে স্টিভ উইটকফ যে মার্কিন প্রতিনিধি দলের নেতৃত্ব দেবেন, তাৎক্ষণিকভাবে তেমন কোনো ঘোষণা আসেনি।
আলোচনার খবরে ইরানের অর্থনীতিতে সুবাতাস
ট্রাম্পের আলোচনার ঘোষণার পর ইরানের বিপর্যস্ত অর্থনীতিতে নতুন করে প্রাণ সঞ্চার হয়েছে। দেশটির মুদ্রা রিয়ালের দর, যা এক ডলারের বিপরীতে ১ মিলিয়নেরও বেশি রিয়ালে পৌঁছে গিয়েছিল, তা মঙ্গলবার ৯ লাখ ৯০ হাজারে ফিরে এসেছে। তেহরান স্টক এক্সচেঞ্জেও প্রায় ২ শতাংশ বৃদ্ধি দেখা গেছে।
আন্তর্জাতিক নিষেধাজ্ঞার কারণে ইরানের অর্থনীতি মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, বিশেষ করে ২০১৮ সালে ট্রাম্পের একতরফাভাবে পারমাণবিক চুক্তি থেকে বেরিয়ে আসার পর। ২০১৫ সালের চুক্তিতে ইরান ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধকরণ এবং মজুদ সীমিত করতে রাজি হয়েছিল, যার বিনিময়ে আন্তর্জাতিক নিষেধাজ্ঞা তুলে নেওয়া হয়। সেই সময় ডলারের বিপরীতে রিয়ালের দাম ছিল ৩২ হাজার।
অর্থনৈতিক অস্থিরতার কারণে জনসাধারণের সঞ্চয় কমে গেছে, ফলে সাধারণ ইরানিরা কঠিন মুদ্রা, সোনা, গাড়ি এবং অন্যান্য মূল্যবান জিনিস ধরে রাখতে বাধ্য হচ্ছেন। অনেকে আবার দ্রুত ধনী হওয়ার আশায় ক্রিপ্টোকারেন্সি বা অন্যান্য স্কিমে ঝুঁকছেন।
ট্রাম্পের চিঠি এবং আলোচনার সূত্রপাত
শনিবার এই আলোচনার সূত্রপাত হয়, যখন ট্রাম্প ইরানের সর্বোচ্চ নেতা আয়াতুল্লাহ আলী খামেনেইকে একটি চিঠি লেখেন এবং তেহরান ও ওয়াশিংটনের মধ্যে সরাসরি আলোচনার প্রস্তাব দেন। তবে খামেনেই ফেব্রুয়ারিতে ট্রাম্পকে তীব্র ভাষায় আক্রমণ করে বলেছিলেন, তার প্রশাসনের সঙ্গে আলোচনা “বুদ্ধিমান, জ্ঞানী বা সম্মানজনক” হবে না।
অন্যদিকে, ট্রাম্প এখনো ইয়েমেনের ইরান-সমর্থিত হুতি বিদ্রোহীদের ওপর তীব্র বিমান হামলা চালিয়ে যাচ্ছেন, যারা তেহরানের স্ব-ঘোষিত “প্রতিরোধ অক্ষ”-এর শেষ শক্তি, যারা গাজা উপত্যকায় হামাসের বিরুদ্ধে ইসরায়েলের যুদ্ধের পর ইসরায়েলে আঘাত হানতে সক্ষম।
ট্রাম্পের প্রতি ইরানের কট্টরপন্থীদের মধ্যে তীব্র ক্ষোভ রয়েছে, বিশেষ করে ২০২০ সালে বাগদাদে ইরানের প্রভাবশালী জেনারেল কাসেম সোলেইমানিকে ড্রোন হামলায় হত্যার সিদ্ধান্তের কারণে। যুক্তরাষ্ট্রের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, ২০২৪ সালের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের আগে ইরান থেকে ট্রাম্পকে হত্যার হুমকি দেওয়া হয়েছিল।
তবে, ইরান এখন ভিন্ন পথে হাঁটতে পারে। কট্টরপন্থী দৈনিক কায়হান শনিবার একটি নিবন্ধে হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করে লিখেছিল, “শহীদ সোলেইমানির রক্তের প্রতিশোধ হিসেবে ট্রাম্পকে তার ফাঁকা মাথায় কয়েকটি বুলেট বিদ্ধ করে হত্যা করা হবে।” এর একদিন পর, ইরানের সংস্কৃতি ও ইসলামিক গাইডেন্স মন্ত্রকের প্রেস সুপারভাইজরি বোর্ড দৈনিকটিকে এই নিবন্ধের জন্য সতর্ক করে, যদিও পত্রিকাটি পরে এটিকে ব্যঙ্গাত্মক হিসেবে বর্ণনা করে।
ট্রাম্পের যুক্তরাষ্ট্র ও ইরানের মধ্যে সরাসরি আলোচনার পরিকল্পনার বিষয়ে জানতে চাইলে ক্রেমলিনের মুখপাত্র দিমিত্রি পেসকভ জানান, মস্কো এই আলোচনাকে স্বাগত জানায় এবং ইরানের পারমাণবিক ইস্যু রাজনৈতিক ও কূটনৈতিক উপায়ে মীমাংসার পক্ষে।
পেসকভ সাংবাদিকদের সঙ্গে এক কনফারেন্স কলে আরও বলেন, “আমরা অবগত আছি যে ওমানে কিছু সরাসরি এবং পরোক্ষ যোগাযোগের পরিকল্পনা করা হচ্ছে এবং আমরা কেবল এটিকে স্বাগত জানাতে পারি, কারণ এটি ইরানের চারপাশের উত্তেজনা কমাতে পারে।” ট্রাম্প বর্তমানে রাশিয়া ও ইউক্রেনের মধ্যে একটি শান্তি চুক্তি নিয়ে আলোচনার চেষ্টা করছেন, যা এর আগে সৌদি আরবেও অনুষ্ঠিত হয়েছিল।
রুশ পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র মারিয়া জাখারোভা জানান, মঙ্গলবার মস্কোতে রাশিয়া, চীন ও ইরানের প্রতিনিধিদের মধ্যে ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচি নিয়ে একটি বিশেষজ্ঞ পর্যায়ের বৈঠক অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা রয়েছে।
তথ্য সূত্র: এসোসিয়েটেড প্রেস