মনের উপর চাপ: ভালো এবং খারাপ – দুশ্চিন্তা নিয়ে কিছু ভুল ধারণা।
আমাদের দৈনন্দিন জীবনে দুশ্চিন্তা বা মানসিক চাপ একটি অতি পরিচিত বিষয়। পরীক্ষার চাপ থেকে শুরু করে অফিসের কঠিন কাজ, সম্পর্কের জটিলতা, আর্থিক দুশ্চিন্তা – এমন নানা কারণে আমরা মানসিক চাপের শিকার হই। তবে মানসিক চাপ নিয়ে অনেক ভুল ধারণা প্রচলিত আছে, যা আমাদের সমস্যাকে আরও বাড়িয়ে তোলে।
আসুন, কিছু প্রচলিত ভুল ধারণা ও তার পেছনের বিজ্ঞান সম্পর্কে বিস্তারিত জেনে নেওয়া যাক।
মানসিক চাপ সবসময় খারাপ? – এই ধারণাটি সঠিক নয়।
মানসিক চাপ আসলে আমাদের শরীরের একটি স্বাভাবিক প্রক্রিয়া। কোনো বিপদ বা হুমকির সম্মুখীন হলে শরীর ‘যুদ্ধ অথবা পলায়ন’ (fight-or-flight) প্রতিক্রিয়ার মাধ্যমে দ্রুত ব্যবস্থা নিতে প্রস্তুত হয়। এই পরিস্থিতিতে কিছু হরমোনের ক্ষরণ বাড়ে, যা আমাদের মনোযোগ বাড়াতে এবং পরিস্থিতি মোকাবিলার জন্য প্রস্তুত করতে সাহায্য করে।
উদাহরণস্বরূপ, একটি প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণকারী খেলোয়াড়ের শরীরে কর্টিসলের মাত্রা সামান্য বাড়লে তার পারফরম্যান্স ভালো হতে দেখা যায়। তবে, চাপ যদি দীর্ঘকাল ধরে চলতে থাকে, তাহলে তা অবশ্যই শরীরের জন্য ক্ষতিকর।
মানসিক চাপ কি শুধু পুরুষ কর্মকর্তাদেরই হয়? – না, এই ধারণা ভুল।
আগে মানসিক চাপ বিষয়ক গবেষণা মূলত পুরুষ এবং উচ্চবিত্তদের মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল। কিন্তু গবেষণায় দেখা গেছে, যাদের জীবনে কাজের চাপ বেশি কিন্তু সেই অনুযায়ী নিয়ন্ত্রণের সুযোগ কম, তারাই মানসিক চাপে বেশি ভোগেন। কারো উপর যদি একাধিক দায়িত্ব থাকে, যেমন – একইসঙ্গে সন্তান ও বয়স্কদের দেখাশোনা করা, অথবা একাধিক চাকরি করা – তবে তাদের মধ্যে মানসিক চাপ বেশি হওয়ার সম্ভাবনা থাকে।
একটি গবেষণায় দেখা গেছে, অ্যামাজন-এর মতো গুদামে শ্রমিকদের কাজ করার ধরন, যেখানে কর্মীদের উপর কাজের চাপ অনেক বেশি এবং প্রতিটি পদক্ষেপ নজরে রাখা হয়, তা মানসিক স্বাস্থ্যের জন্য খুবই ক্ষতিকর।
মানসিক চাপ কি নতুন সমস্যা? – না, এটিও ভুল ধারণা।
আসলে মানসিক চাপ মানুষের একটি পুরোনো সমস্যা। ১৯৩০-এর দশকে হান্স সেলি নামের একজন চিকিৎসক ইঁদুরের উপর পরীক্ষা করে দেখিয়েছিলেন যে, ক্রমাগত মানসিক চাপ শরীরের ক্ষতি করে। এমনকি, রেলযাত্রা ও টেলিগ্রাফের মতো নতুন প্রযুক্তি আসার পরও ভিক্টোরিয়ান যুগে মানুষেরা এটিকে মানসিক চাপের কারণ হিসেবে চিহ্নিত করেছিলেন।
ছোটখাটো বিষয়গুলোই কি মানসিক চাপের মূল কারণ? – হ্যাঁ, এটি অনেক ক্ষেত্রে সত্য।
ছোটখাটো উদ্বেগগুলো, যেমন – সময় মতো অফিসের কাজ শেষ করতে না পারা, অপ্রত্যাশিত বিল আসা, ইত্যাদি বিষয়গুলো আমাদের মানসিক স্বাস্থ্যের উপর দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব ফেলে। চার্লস বুকোভস্কি তাঁর ‘দ্য শোল্যাস’ কবিতায় বলেছিলেন, মানুষ হয়তো বড় ধরনের বিপর্যয় সামলে নিতে পারে, কিন্তু “ছোট ছোট দুঃখগুলো” তাদের জন্য অনেক বেশি কষ্টের কারণ হয়।
তবে, এই ‘ছোট’ বিষয়টি ব্যক্তিভেদে ভিন্ন হতে পারে। কারো জন্য সামান্য একটি বিলও অনেক বড় উদ্বেগের কারণ হতে পারে, যা তাঁর আর্থিক অবস্থার উপর নির্ভর করে।
শারীরিক ব্যায়াম কি সবসময় মানসিক চাপ কমায়? – সবসময় নয়।
যদিও ব্যায়াম মানসিক চাপ কমাতে সাহায্য করে, তবে অতিরিক্ত ব্যায়াম অনেক সময় পরিস্থিতি আরও খারাপ করে তোলে। কিছু গবেষণায় দেখা গেছে, তীব্র ব্যায়ামের ফলে শরীরে কর্টিসলের মাত্রা বেড়ে যেতে পারে, যা মানসিক চাপ বাড়াতে সহায়ক।
ব্যায়াম যদি কঠিন এবং একঘেয়ে লাগে, তবে সেটিও মানসিক চাপের কারণ হতে পারে। তাই, হালকা ব্যায়াম, যেমন – যোগা, অনেক ক্ষেত্রে বেশি উপকারী হতে পারে।
মানসিক চাপে কি ওজন কমে? – সবসময় না।
মানসিক চাপের কারণে কারো ওজন কমতে পারে, আবার কারো ক্ষেত্রে বাড়তে পারে। সাধারণত, মানসিক চাপে থাকা প্রায় দুই-তৃতীয়াংশ মানুষের ওজন বাড়ে। এর কারণ হলো হরমোনের পরিবর্তন এবং অস্বাস্থ্যকর খাদ্যাভ্যাস।
অতিরিক্ত কর্টিসলের কারণে পেটে চর্বি জমে এবং মানসিক চাপে থাকা ব্যক্তিরা ফাস্ট ফুড বা মিষ্টি জাতীয় খাবার বেশি গ্রহণ করে, যা ওজন বাড়াতে সহায়ক।
পশুদের কি মানসিক চাপ হয়? – হ্যাঁ, হয়।
মানুষের মতো অন্যান্য প্রাণীরও মানসিক চাপ হয়। তাদের শরীরেও ‘যুদ্ধ অথবা পলায়ন’ করার মতো হরমোনের নিঃসরণ ঘটে। তবে মানুষের ক্ষেত্রে, ভবিষ্যতের জন্য দুশ্চিন্তা করার প্রবণতা বেশি দেখা যায়। এই মানসিক চাপ আমাদের পরীক্ষার প্রস্তুতি নিতে বা কোনো গুরুত্বপূর্ণ কাজ সময় মতো শেষ করতে সাহায্য করতে পারে।
মানসিক চাপের জন্য কি আমরা নিজেরাই দায়ী? – একেবারেই না।
মানসিক চাপের পেছনে অনেকগুলো কারণ থাকতে পারে, যা আমাদের নিয়ন্ত্রণে নাও থাকতে পারে। আমাদের পারিপার্শ্বিক অবস্থা, শৈশবকাল এবং অতীতের অভিজ্ঞতাও এর জন্য দায়ী হতে পারে। দরিদ্র মানুষেরা যখন একটি অপ্রত্যাশিত বিলের কথা চিন্তা করে, তখন তাদের মানসিক চাপ আরও বাড়ে এবং এর ফলস্বরূপ তাদের জ্ঞানীয় ক্ষমতা কমে যেতে পারে।
মানসিক চাপ থেকে বাঁচার কি কোনো উপায় নেই? – আছে, অবশ্যই আছে।
মানসিক চাপ কমানোর অনেক উপায় আছে। নিয়মিত ব্যায়াম, সঠিক খাদ্যাভ্যাস, পর্যাপ্ত ঘুম, সামাজিক সম্পর্ক বজায় রাখা, এবং মনোচিকিৎসা এক্ষেত্রে সাহায্য করতে পারে। মানসিক চাপ থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্য একজন মানুষের জন্য যা কার্যকর, তা অন্যজনের জন্য নাও হতে পারে।
তাই নিজের জন্য সঠিক উপায় খুঁজে বের করা জরুরি।
যদি আপনি অতিরিক্ত মানসিক চাপে ভুগেন, তাহলে একজন বিশেষজ্ঞের পরামর্শ নিন। এছাড়া, আপনার এলাকার মানসিক স্বাস্থ্য সহায়তা কেন্দ্রে যোগাযোগ করতে পারেন।
তথ্য সূত্র: দ্য গার্ডিয়ান