সিরিয়ার আলওয়াইত সম্প্রদায়ের উপর প্রতিশোধমূলক হামলা এখনো চলছে, উদ্বাস্তু জীবনের দিকে ঝুঁকছে হাজারো মানুষ।
সিরিয়ার পরিস্থিতি এখনো স্বাভাবিক হয়নি। বাশার আল-আসাদের পতনের পর দেশটির সংখ্যালঘু আলওয়াইত সম্প্রদায়ের মানুষজন এখনো পর্যন্ত প্রতিশোধমূলক হামলার শিকার হচ্ছেন। এপ্রিল মাসের শুরু থেকে ছোটখাটো হামলাগুলোতে নিহত হয়েছেন বহু মানুষ।
খবর সূত্রে জানা যায়, প্রতিশোধের আগুনে এখনো জ্বলছে সিরিয়ার অনেক অঞ্চল।
একসময় বাশার আল-আসাদের শাসনের অধীনে আলওয়াইত সম্প্রদায় প্রভাবশালী ছিল। কিন্তু ক্ষমতা হারানোর পর থেকেই সুন্নি সম্প্রদায়ের প্রতিশোধের ভয়ে দিন কাটাচ্ছেন তারা। নতুন সরকার সংখ্যালঘুদের নিরাপত্তা দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিলেও, তা এখনো পর্যন্ত পূরণ হয়নি।
মানবাধিকার সংস্থাগুলোর তথ্য অনুযায়ী, মার্চ মাসেই ১,৭০০ জনের বেশি মানুষ নিহত হয়েছেন, যাদের অধিকাংশই বেসামরিক নাগরিক।
সংস্থাগুলো জানাচ্ছে, বিদ্রোহের সঙ্গে জড়িত না থেকেও আলওয়াইত সম্প্রদায়ের অনেক মানুষকে লক্ষ্য করে হামলা চালানো হয়েছে।
অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের সিরিয়া বিষয়ক গবেষক ডায়ানা সেমান জানিয়েছেন, “বহু মানুষ জানিয়েছেন, হামলাকারীরা তাদের বাড়িতে ঢুকে আলওয়াইত নাকি সুন্নি—এই প্রশ্ন করার পাশাপাশি প্রাক্তন আসাদ সরকারের আমলে তাদের ওপর ঘটে যাওয়া ঘটনার জন্য তাদের দায়ী করেছে।
সংস্থাটি বানিয়াসে সংঘটিত হত্যাকাণ্ডের ঘটনা তদন্ত করেছে এবং প্রত্যক্ষদর্শী ও জীবিতদের সঙ্গে কথা বলেছে।
যদিও আগের মতো ব্যাপকহারে সহিংসতার খবর পাওয়া যাচ্ছে না, তবে এখনো পর্যন্ত আলওয়াইত সম্প্রদায়ের উপর হয়রানি, চাঁদাবাজি এবং মাঝে মাঝে আরও গুরুতর হামলার ঘটনা ঘটছে।
লাটাকিয়ার একজন আলওয়াইত সম্প্রদায়ের মানুষ নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানান, “আসাদ সরকারের সঙ্গে জড়িত বা তার ঘনিষ্ঠ অনেকেই অনেক আগেই এলাকা ছেড়ে পালিয়েছে। যারা এখনো এখানে আছে, তারা নিয়মিত হামলার শিকার হচ্ছে।
তিনি আরও জানান, “একটি স্থানীয় চেকপোস্টে একজন ২০ বছর বয়সী কারখানার কর্মীকে গুলি করে হত্যা করা হয়েছে, যদিও তিনি আসাদের অধীনে সেনাবাহিনীতে কাজ করেননি।
হামলার ঘটনা লাটাকিয়া থেকে পার্শ্ববর্তী প্রদেশ তারতুসেও ছড়িয়ে পড়েছে। পরবর্তীতে তা হোমসের মতো প্রধান শহরেও আঘাত হেনেছে।
সিরিয়ান অবজারভেটরি ফর হিউম্যান রাইটস-এর প্রধান রামি আবদুর রহমান জানিয়েছেন, ঈদুল ফিতরের পর থেকে সাম্প্রদায়িক হামলায় ৪২ জন নিহত হয়েছেন।
হোমসের একজন সমাজকর্মী মোহাম্মদ সালেহ, যিনি বাশার আল-আসাদ ও তাঁর বাবার শাসনের সময় ১৭ বছর কারাগারে ছিলেন, জানান, নিহতদের মধ্যে এমন আলওয়াইত সম্প্রদায়ের মানুষও রয়েছেন, যারা আসাদ সরকারের বিরোধী ছিলেন।
তিনি আরও জানান, “গত মাসের হামলায় তাঁর পরিচিত ১৮ জন নিহত হয়েছেন, যাদের আগে আসাদের বাহিনী আটক করেছিল।
সালেহ আশঙ্কা প্রকাশ করে বলেন, “সিরিয়া একনায়কতন্ত্র থেকে আরেকটিতে পরিণত হচ্ছে।
তিনি বলেন, “আমরা চাই একটি শক্তিশালী জাতীয় সেনাবাহিনী এবং নিরাপত্তা সংস্থা, যারা সবার নিরাপত্তা দেবে এবং কোনো বিশেষ সম্প্রদায়ের প্রতি পক্ষপাতিত্ব করবে না।
যদি নিরাপত্তা সংস্থাগুলো কোনো একটি সম্প্রদায়ের অন্তর্ভুক্ত হয়, তাহলে সেখানে সবার জন্য রাষ্ট্র গঠিত হতে পারে না।
পরিস্থিতি এতটাই গুরুতর যে, তারতুস প্রদেশের বানিয়াসের একটি উচ্চ বিদ্যালয় গত মাসে হামলায় নিহত শিক্ষক, শিক্ষার্থী এবং প্রাক্তন শিক্ষার্থীসহ প্রায় ৮০ জনের একটি তালিকা ফেসবুকে প্রকাশ করেছে।
সোশ্যাল মিডিয়ায় ব্যাপকভাবে প্রচারিত একটি ভিডিওতে দেখা যায়, দুই যুবকের মৃতদেহের পাশে তাঁদের মা দাঁড়িয়ে আছেন। ভিডিওতে তাঁদেরকে আলওয়াইত হওয়ার কারণে তাঁদের ছেলেদের মৃত্যুর জন্য অভিযুক্ত করা হচ্ছে।
এই পরিস্থিতিতে হাজার হাজার আলওয়াইত সম্প্রদায়ের মানুষজন উদ্বাস্তু হয়ে লেবাননে আশ্রয় নিচ্ছেন।
জাতিসংঘের শরণার্থী সংস্থা জানিয়েছে, গত এক মাসে প্রায় ৩০,০০০ সিরীয় আলওয়াইত লেবাননে পালিয়ে গিয়েছেন। তাঁরা লেবাননের বিভিন্ন শহরে আশ্রয় নিয়েছেন।
সেখানে তাঁদের জন্য পর্যাপ্ত সহায়তা নেই, তাই তাঁরা এখনো পর্যন্ত সিরিয়ায় ফিরতে পারছেন না।
আসাদের পতনের পর সিরিয়ার সংখ্যালঘুদের ওপর সহিংসতা বন্ধ হবে—এমনটা আশা করা হলেও, বাস্তবে তা হয়নি।
নতুন সরকার অপরাধীদের বিচারের আওতায় আনার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে এবং অন্তর্বর্তীকালীন প্রেসিডেন্ট আহমাদ আল-শারার সাম্প্রতিক হামলার জন্য দায়ী ব্যক্তিদের বিচারের ঘোষণা দিয়েছেন।
তবে, মানবাধিকার সংস্থাগুলো বলছে, সরকারের এই প্রতিশ্রুতি রক্ষা করা একটি কঠিন পরীক্ষা।
তথ্য সূত্র: অ্যাসোসিয়েটেড প্রেস।