‘গণমাধ্যম-গণতন্ত্র, সুশাসন এবং প্রেক্ষিত বাংলাদেশ’
একটি দেশের গণমাধ্যম-গণতন্ত্র, সুশাসন এবং ভোটাধিকার প্রশ্নে প্রথমেই যেটি অগ্রাধিকার পায় সেটি হচ্ছে দেশটির গণমাধ্যম ও সাংবাদিক সুরক্ষার জায়গাটি কতটুকু নিশ্চিত করা হয়েছে। একই সাথে প্রশাসন কতটুকু নিরপেক্ষ নীতিতে অটল । রাজনৈতিক দলগুলো এবং ক্ষমতায় থাকা সরকারকে গণমাধ্যম ও সাংবাদিকদের চুলছেরা বিশ্লেষণ এবং সমালোচনাকে কতটুকু গ্রহণ করতে পারে সেটাও সুশাসনের একটা অংশ। কথায় কথায় গণমাধ্যমের টুটি চেপে ধরা হলে ধরে নিতে হবে রাষ্ট্র পরিচালনায় থাকা সরকার বা রাজনৈতিক দলের লোকেরা সমালোচনাকে সহ্য করতে পারছেনা, এটি একটি ব্যর্থতা। সুশাসন প্রশ্নে রাষ্ট্র ক্ষমতায় থাকা যে কোন রাজনৈতিক দল বা সরকারকে গণমাধ্যমের সমালোচনায় সৃষ্টি হওয়া ক্ষতের জায়গাটি সংশোধনের মানসিকতা তৈরী রাখা উচিত।
‘একটি দেশে দীর্ঘদিন ধরে সুশাসন, গণতন্ত্র আর ভোটাধিকারের জায়গাটি যদি অরক্ষিত থাকে সেখানে গণমাধ্যম নানা ভাবে লেখালেখির মাধ্যমে রাজনৈতিক দল বা সরকারকে সুরসুরি দিতেই পারে, এতে ক্ষিপ্ত হবার কিছু নেই’।
রাষ্ট্রের মৌলিক প্রশ্নে গণমাধ্যম এবং সাংবাদিকদেরকে সাহস এবং উৎসাহ জোগাবে রাষ্ট্রের দায়িত্বশীল মানুষেরা। বহি:বিশ্বের বিভিন্ন রাষ্ট্র বেতন-ভাতা দিয়ে তাদের সমালোচনা বা ভুল গুলো ধরিয়ে দিতে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানকে নিযুক্ত করে থাকেন। বিশ্বের উন্নত দেশ গুলো গণমাধ্যমের সমালোচনা সহ্য করে তাদের দেখানো পথেই হাটেন।
‘গণমাধ্যম হচ্ছে একটি দেশের এন্ট্রিবায়োটিকের মত’। কোন দেশ তথা রাজনৈতিক দলগুলো যখন ভুল পথে হাটে তখন একমাত্র গণমাধ্যমই তাদের পথ দেখাতে পারে। তবে সেটি কিন্তু কোন দলকানা মনোভাবাটন্ন গণমাধ্যম বা সাংবাদিকদের দ্বারা সম্ভব নয়। কিন্তু আমাদের দেশের বিভিন্ন সরকার বা রাজনৈতিক দল গুলো গণমাধ্যমকে পক্ষপাতদুষ্ট মনে করে ছিটকে ফেলে দেয়, তাদের মতকে গুরুত্বহীন বলে উড়িয়ে দিয়ে হুমকি দেয়, যা একটি দেশের জন্য মঙ্গলকর হতে পারেনা।
যে কথাটি বলে রাখা দরকার সেটি হচ্ছে সাংবাদিক সুরক্ষা। বাংলাদেশ নামের এই রাষ্ট্রের মাঝে দেশ স্বাধীনের ৫৩টি বছর অতিবাহিত হয়ে গেলেও গণমাধ্যম ও সাংবাদিকদের জন্য কোন সুরক্ষার জায়গা তৈরী হয়নি। সরকার আসে সরকার যায় সাংবাদিকদের সাথে কেউ কথা রাখেনা। কথার ফুলঝুরি ছিটিয়ে সময় পার করে নিতেই তারা অভ্যস্ত।
আশ্চর্য্যজনক হলেও সত্যি যে, বিগত ৫৩ বছরেও বাংলাদেশে প্রণীত হয়নি সাংবাদিক নিয়োগ নীতিমালা। কে সাংবাদিক হবেন, তার শিক্ষাগত যোগ্যতা কি হবে, কিভাবে একজন সাংবাদিকের কর্মক্ষেত্রে স্থায়িত্ব লাভ করবে এ বিষয় গুলো আজও প্রণয়ন করা সম্ভব হয়নি। যার ফলে আজ রাস্তাঘাটে যে কেউ-ই সাংবাদিক! ফলে সমালোচনা আর তুচ্ছতাচ্ছিল্যের কেন্দ্র বিন্দুতে এখন গণমাধ্যম আর সাংবাদিক। কেউবা কাউকে কোন রাজনৈতিক দলের দোসর সাজিয়ে, বিভিন্ন ভাবে আক্রমণ -আক্রোশে যেন পুরো গণমাধ্যম আজ প্রশ্নবিদ্ধে আহত-লন্ডভন্ড। হামলা, মামলা, ভাংচুর, দখলদারিত্বের কবলে পড়ে নতজানু হয়ে গেছে গণমাধ্যম শিল্প এবং সাংবাদিকতা। কারণ হিসেবে স্মরণ করিয়ে দিতে চাই, বাড়তি কিছু পাবার লোভে অধিকাংশ গণমাধ্যম মালিক- সাংবাদিকেরা রাজনীতির গলা জড়িয়ে ধরে চলছে; যা কখনো কাম্য ছিল না। লোভের ফাঁদে পড়ে বিগত আওয়ামী সরকার আমলের বহু সাংবাদিক এবং সম্পাদকদের হাতে হাতকড়া এ জাতিকে দেখতে হয়েছে। এ থেকে সাংবাদিকতায় আগামীর প্রজন্ম শিক্ষা নিতে পারে, সাংবাদিকতা এবং রাজনীতি একযোগে চলেনা-চলতে পারেনা। মনে রাখা উচিত আপনি যখন সাংবাদিক, আপনি সমাজের অনেক দায়িত্বশীল বড় মাপের একজন মানুষ, এতটুকুই আপনার প্রাপ্তি। কিন্তু এর চেয়ে যখন বেশি কিছু পাবার লোভ সামলাতে পারবেন না তখন হাতকড়া আর ডাণ্ডাবাজি আপনারই প্রাপ্য।
গণমাধ্যমকে দূর্বল করে রাখা রাজনৈতিক দলের লোকজন এবং সরকারের নেশায় পরিনত হয়ে গেছে। কথায় কথায় চাকরী ছাটাই, সাংবাদিকের চাকরী যেন কচুঁ পাতার পানির মত। এ গুলোর জন্য বিগত বিভিন্ন সরকার এবং রাজনৈতিক দল গুলোই বেশি দায়ি। তবে সাংবাদিক সংগঠন গুলো এবং সিনিয়র সাংবাদিকরাও এ জন্য কম দায়ি নয়। বিশেষ করে রাজনৈতিক দলের লেজুরবৃত্তি সাংবাদিকতা আমাদের এই পেশাটির জন্য বেশি হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে। অন্য সকল পেশার মত সাংবাদিকতার মাঝেও দলীয় খঢ়গ আশংকাজনক হারে বাড়ছে, যা আগামীর সাংবাদিকতার জন্য চরম হুমকিস্বরূপ। অথচ, সাংবাদিকদের মাঝে কখনো রাজনৈতিক লোভ ছুঁতে পারার কথা নয়; তবুও অদৃশ্য হারে বেড়ে আজ প্রকাশ্য সাংবাদিক রাজনীতি মহীরুহ আকার ধারণ করেছে।
সাংবাদিক সুরক্ষার মাঝে পেশাটির সাথে জড়িতদের রুটি-রুজির নিশ্চয়তার বিষয়টিও কম গুরুত্বপূর্ন নয়। আর সে ক্ষেত্রে বিগত সরকার গুলো দায়িত্বিহীনতার ছাপ রেখে গেছেন। ওয়েজবোর্ড নামের যে সোনার হরিণটির ছোঁয়া দেশের ৯০ ভাগ সাংবাদিকের ভাগ্যে জুটছেনা। তবুও তারা দেশ তথা রাষ্ট্রের অতন্দ্র প্রহরীর ন্যায় পেশাগত দায়িত্ব পালন করেই চলছেন। তার মাঝে নিরাপত্তা সুরক্ষার বিপরীতে মামলা-হামলার জালে আটকে পড়ছেন হাাজারো সাংবাদিক। রাষ্ট্রের পক্ষে কাজ করতে গিয়ে একাই লড়ে যাচ্ছেন মামলার লড়াইয়ে। মিথ্যা-ষড়যন্ত্রমূলক মামলায় জেল-জুলুম-হুলিয়া মাথায় নিয়ে পরিবার ছেড়ে কখনো পালিয়ে বেড়াতে হয় সাংবাদিককে। এক্ষেত্রে রাষ্ট্র তাদের পাশে থাকেনা; অথচ সাংবাদিকরা রাষ্ট্রের। বলা হয়ে থাকে গণমাধ্যম রাষ্ট্রের চতুর্থ স্তম্ভ, আর এই স্তম্ভের সাথে জড়িত সাংবাদিকরা তাহলে কোন স্তরের, সে প্রশ্ন থেকেই যায়। সাংবাদিকদের সুরক্ষার দায়িত্ব যদি রাষ্ট্রেরই হয়ে থাকে তবে কেনো রাষ্ট্রীয় প্রশাসন দ্বারা প্রতিনিয়ত সাংবাদিকরা হেনস্থা, হয়রাণী এবং মামলার শিকার হচ্ছেন। এমনও দেখা যায় সাংবাদিকের বিরুদ্ধে কেউ মামলা করবেন এমন খবরে পুলিশ অতিউৎসাহী হয়ে এগিয়ে গিয়ে মামলা রেকর্ড করে থাকেন। আরেকটু যদি সহজ করে বলতে যাই তবে চিত্রটি এমন যে, জনৈক ব্যক্তি কোন সাংবাদিকের বিরুদ্ধে মামলা করবেন আর ঐ মামলার কম্পোজ কোন কম্পিউটার দোকানে চলছে সেখানে গিয়ে পুলিশ বাদিকে খুঁজে আগে আসামী সাংবাদিককে গ্রেফতার করেন পরে মামলা রেকর্ড। এ সব চিত্র শুধু পুলিশ সাংবাদিকের সাথেই করে থাকেন, যা চরম দূ:খজনক।
আজকাল রাষ্ট্রের অভ্যন্তরে সরকারি বিভিন্ন দপ্তরে চাকরিতে কর্মরতরা সাংবাদিকদের চক্ষুশুল হিসেবেই মনেপ্রাণে ধারণা লালন করে থাকেন। সাংবাদিকরা তথ্য চাওয়ায় নানা তালবাহানা, হয়রাণী, হুমকি, লাঞ্ছিত এমনকি চাঁদা দাবির অভিযোগ তুলে পুলিশের কাছে মামলার ঘটনা অহরহ। মনে রাখা উচিত, এই দেশটা আপনার, আমার এবং সবার। কেউ কারো প্রতিপক্ষ নহে।
রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা-সুরক্ষার অভাবে ঝুঁকিপূর্ণ এ পেশাটি ধীরেধীরে আরো বেশি নিরাপত্তাহীন হয়ে উঠছে। বিভিন্ন এলাকায় বহু সাংবাদিক প্রাণ ভয়ে পেশা ছেড়ে দিয়ে ভিন্ন পেশায় পাড়ি জমাচ্ছে, কেউবা দেশ ছেড়ে বিদেশেও চলে গেছে।
মহৎ পেশা সাংবাদিকতা। নানা মহলের অসহযোগিতা আর কুৎসায় পেশাটি আজ তার মর্যাদা, সম্মান, শ্রীবৃদ্ধি হারিয়ে তাচ্ছিল্যের পেশায় রূপ নিয়েছে। মোট কথা দেশের অধিকাংশ চোর-ডাকাত, ঘুষখোর-সুদখোর, দূর্ণীতি, দখলবাজ, অস্ত্রবাজ, সিন্ডিকেট আর সন্ত্রাসীদের কাছে গণমাধ্যম ও সাংবাদিকরা তুচ্ছ। এতসব সিন্ডিকেটের কাছে সাংবাদিকরা জিম্মি। নিরাপত্তাহীন কলম দিয়ে সব কিছুর বিরুদ্ধে লড়াই করা যায়না। রাষ্ট্রীয় বিভিন্ন দপ্তর সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা-কর্মচারীদের অনেকেরই প্রত্যাশা পেশাটি ধীরেধীরে দূর্বল হয়ে গেলে তারা তাদের মত সবকিছু লুটেপুটে খেতে আর বাধা থাকলোনা।
যে সমাজ বা রাষ্ট্রে ৫৩ বছরেও সাংবাদিক নিয়োগ নীতিমালা, সাংবাদিক সুরক্ষা আইন, সাংবাদিকদের তালিকা প্রণয়ন করার মত গুরুত্বপূর্ণ কাজগুলো অসম্পূর্ন সেখানে কী করে অদূর ভবিষ্যতে এগুলো সম্ভব হবে তা জানা নেই। সাংবাদিক নিয়োগ নীতিমালা না থাকায় যেকোন সাংবাদিককে যেকোন দিন চাকরীচ্যুত করা যাবে তাতে কারো কিছু করার নেই; সাংবাদিকদের চাকরী যেন কচু পাতায় পানি। অথচ কোন হোটেল কর্মচারী, কোন মুদি দোকানের কর্মচারী কিংবা কোন গার্মেন্টস শ্রমিককে মালিক ইচ্ছা করলেই আজই বাদ দিতে পারেনা, কিন্তু সাংবাদিকের বেলায় তা প্রযোজ্য এবং সম্ভব। অথচ আমাদের গণমাধ্যম গুলো চরম মানবাধিকার রক্ষায় ব্যস্ত।
সাংবাদিক সুরক্ষার প্রশ্নে যদি বলা হয়, গণমাধ্যম যেহেতু রাষ্ট্রের চতুর্থ স্তম্ভ আর এই স্তম্ভের সাথে জড়িত সাংবাদিকরাও রাষ্ট্রের পক্ষে
পেশাগত দায়িত্ব পালন করে থাকেন। আর এই দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে রাষ্ট্রীয় শেল্টার বা নিরাপত্তা পাবেন, এটাই সত্য হবার কথা।
এখানে কী হচ্ছে, রাষ্ট্রের অপরাপর তিনটি স্তম্ভের সাথে জড়িতরা যেকোন ধরনের রাষ্ট্রীয় সুযোগ-সুবিধা পেয়ে থাকেন, কিন্তু সাংবাদিকরা তার কিছুই পাননা।
যেমন ধরুন রাষ্ট্রের সরকারি যেকোনো অধিদপ্তরের লোকেরা যেকোনো ধরনের কাজ করতে গিয়ে কোন পক্ষের দ্বারা ক্ষতিগ্রস্ত কিংবা বাধাগ্রস্থ হলে রাষ্ট্রীয় কাজে বাঁধাদানের অভিযোগে বিচারের সুযোগ পান কিন্তু সাংবাদিকরা কিছুই পান না! তাহলে কেন তারা রাষ্ট্রের চতুর্থ স্তম্ভের মুলা ঝুলিয়ে গণমাধ্যম এবং সাংবাদিকদেরকে এই ঝুকিপূর্ণ কাজ গুলো করানো হয়! জানি কেউ এর জবাব দিতে পারবেন না, তবুও
সাংবাদিকরা জীবন বাজি রেখে রাষ্ট্রের পক্ষে কাজ চালিয়ে যাচ্ছেন।
সবশেষ : একটি দেশের স্বার্থে, স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব, গণতন্ত্র, সুশাসন ও ভোটাধিকার প্রশ্নে সাংবাদিক সুরক্ষা অতীব গুরুত্বপূর্ণ। গণমাধ্যম এবং সাংবাদিকদেরকে দূর্বল করে কোন কিছুই করা সম্ভব হয়নি, হতে পারে না।
লেখক : আহমেদ আবু জাফর, চেয়ারম্যান, ট্রাস্টি বোর্ড, বাংলাদেশ মফস্বল সাংবাদিক ফোরাম-বিএমএসএফ, ৯ নভেম্বর, ২০২৪ খ্রী:। 01712306501
[email protected]