প্রাচীন ইতালির মুরানো, কাঁচ শিল্পের এক উজ্জ্বল ঠিকানা। আর সেই মুরানোতেই এক তরুণ, যিনি যুক্তরাষ্ট্রের বোস্টন থেকে এসে কাঁচ তৈরির কারিগরদের মধ্যে অন্যতম পরিচিত মুখ হয়ে উঠেছেন।
তাঁর নাম রবার্তো বেলট্রামি। মাত্র ৩৪ বছর বয়সেই তিনি মুরানোর সবচেয়ে কম বয়সী কাঁচ শিল্পী হিসেবে পরিচিতি লাভ করেছেন।
বোস্টাতে পদার্থবিদ্যার ছাত্র থাকাকালীন, ২০১১ সালে রবার্তো আমেরিকান শিল্পী ডেল চিহুলির কাজ দেখে মুগ্ধ হন। চিহুলির কাঁচশিল্পের ব্যতিক্রমী কাজ বেলট্রামিকে এতটাই আকৃষ্ট করে যে, তিনি এই শিল্পের প্রতি আগ্রহী হয়ে ওঠেন।
এরপর গ্রীষ্মের ছুটিতে ইতালির মুরানো দ্বীপে কাঁচ তৈরির একটি প্রশিক্ষণ কর্মশালায় যোগ দেন তিনি। ধীরে ধীরে এই প্রশিক্ষণ একটি শিক্ষানবিশির রূপ নেয়।
এরপর বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠ চুকিয়ে বেলট্রামি পুরোদমে এই শিল্পের সঙ্গে যুক্ত হন।
মুরানোর কাঁচশিল্পের ৭০০ বছরের ইতিহাস রয়েছে। একসময় এই শিল্প বিশ্বজুড়ে খ্যাতি লাভ করে।
স্বচ্ছ কাঁচ তৈরির কৌশল ‘ক্রিস্টালো’ আবিষ্কারের মাধ্যমে মুরানো নতুন দিগন্ত উন্মোচন করে। কিন্তু সময়ের সঙ্গে সঙ্গে এই শিল্পে ভাটা পড়ে, কারখানার সংখ্যাও কমতে শুরু করে।
অনেকের মতে, তরুণ প্রজন্মের মধ্যে এই শিল্পের প্রতি আগ্রহ কমে যাচ্ছে।
তবে বেলট্রামির অভিজ্ঞতা ভিন্ন। তাঁর মতে, মুরানোর পুরনো কর্মশালাগুলোতে গোপনীয়তা রক্ষার প্রবণতা বেশি ছিল।
নতুনদের সহজে এখানে কাজ শেখানো হতো না। কারণ, সবাই নিজের কাজ হারানোর ভয়ে থাকতেন।
বেলট্রামি জানান, কাঁচ শিল্পের প্রতি তাঁর প্রবল আগ্রহ থাকা সত্ত্বেও, সহজে কিছু শেখার সুযোগ ছিল না।
এই পরিস্থিতিতে বেলট্রামি নিজের কর্মশালা তৈরির সিদ্ধান্ত নেন। ২০১৭ সালে তিনি ‘ওয়েভ মুরানো গ্লাস’ নামে একটি কারখানা স্থাপন করেন।
বর্তমানে তাঁর কারখানায় ২০ জনের একটি দল কাজ করেন, যাদের অধিকাংশই তরুণ।
বেলট্রামি মনে করেন, মুরানোতে এমন চিত্র আগে দেখা যায়নি। তাঁর কারখানায় গড় বয়স ৩৫ বছরের নিচে।
কাঁচ তৈরি একটি জটিল প্রক্রিয়া। প্রায় ১,৬০০ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রায় বালি, সোডা অ্যাশ ও চুনাপাথর গলিয়ে কাঁচ তৈরি করা হয়।
গলিত কাঁচকে একটি নল দিয়ে ফুঁ দিয়ে প্রয়োজনীয় আকার দেওয়া হয়। এরপর ঠান্ডা করে একে শক্ত রূপ দেওয়া হয়।
মুরানোর কারিগররা এই কাজে অত্যন্ত দক্ষ ছিলেন, বিশেষ করে বিভিন্ন রঙের কাঁচ তৈরি করতে তাঁরা পারদর্শী ছিলেন।
বিভিন্ন রাসায়নিক উপাদান ব্যবহারের মাধ্যমে তাঁরা কাঁচকে বিভিন্ন রঙে রাঙাতেন।
বেলট্রামি মনে করেন, কাঁচ তৈরি একটি দলবদ্ধ খেলা। কারণ, একা এই কাজটি করা প্রায় অসম্ভব।
কাঁচের আকার ও ওজনের কারণে কমপক্ষে কয়েকজন লোক একসঙ্গে কাজ করেন।
বেলট্রামি তাঁর কারখানায় আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করেছেন। তিনি প্রশাসনিক কাজের জন্য কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (এআই) নির্ভর সফটওয়্যার ব্যবহার করেন এবং শক্তি সাশ্রয়ী চুল্লি স্থাপন করেছেন।
তাঁর এই উদ্যোগের ফলে গ্যাসের ব্যবহার প্রায় ৮০ শতাংশ কমেছে।
বেলট্রামি ছোট আকারের পরিবর্তে, এক থেকে এক হাজার ২০০টি পর্যন্ত কাঁচের জিনিস তৈরির সুযোগ রেখেছেন।
তাঁর কারখানার উৎপাদিত পণ্যের একটা বড় অংশ বিভিন্ন ব্র্যান্ড, ডিজাইনার ও শিল্পীদের জন্য তৈরি করা হয়।
এছাড়াও, তিনি কাঁচ তৈরির কৌশল সম্পর্কে ধারণা দিতে প্রশিক্ষণ ও ভ্রমণের ব্যবস্থা করেন।
বেলট্রামির এই উদ্যোগের ফলে অনেকেই অনুপ্রাণিত হয়েছেন। তিনি বিশ্বজুড়ে তরুণ ও আগ্রহী কর্মীদের ইন্টার্নশিপের সুযোগ করে দিয়েছেন।
বর্তমানে তাঁর কারখানায় অনেক নারীও কাজ করেন, যা এই শিল্পে একটি ইতিবাচক পরিবর্তন।
বেলট্রামির মতে, ঐতিহ্য ও আধুনিকতার সমন্বয়ে এই শিল্পের ভবিষ্যৎ উজ্জ্বল।
তথ্য সূত্র: সিএনএন