বর্তমান বিশ্বে, চিকিৎসা বিজ্ঞান মানুষের জীবন বাঁচানোর জন্য প্রতিনিয়ত নতুন দিগন্ত উন্মোচন করছে। অঙ্গ প্রতিস্থাপন (Organ Transplantation) তেমনই একটি অত্যাশ্চর্য প্রক্রিয়া, যা গুরুতর অসুস্থ রোগীদের নতুন জীবন দান করে।
আজ আমরা জানব এই প্রতিস্থাপন প্রক্রিয়ার ক্রমবিকাশ এবং এর ভবিষ্যৎ সম্ভাবনা নিয়ে।
অঙ্গ প্রতিস্থাপনের ধারণাটি নতুন না হলেও, এর সফল প্রয়োগ ছিল কঠিন এবং অনেক পরীক্ষার ফল। ১৯ শতকের শুরুতে, বিজ্ঞানীরা যখন প্রাণী থেকে মানুষের শরীরে অঙ্গ প্রতিস্থাপনের চেষ্টা করেন, তখন এর যাত্রা খুব সহজ ছিল না।
ফরাসি চিকিৎসক ড. ম্যাথিউ জাবুলে (Dr. Mathieu Jaboulay) ১৯০৬ সালে প্রথম একটি শূকরের কিডনি (pig kidney) মানুষের শরীরে প্রতিস্থাপনের চেষ্টা করেন। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত, সেই প্রচেষ্টা সফল হয়নি।
১৯৫০-এর দশকে, চিকিৎসা বিজ্ঞানে আসে এক যুগান্তকারী পরিবর্তন। ১৯৫৪ সালে, যুক্তরাষ্ট্রের বোস্টনে (Boston) ড. জোসেফ মারে (Dr. Joseph Murray) যমজ দুই ভাইয়ের মধ্যে কিডনি প্রতিস্থাপন করেন এবং এটি সফল হয়।
এই সাফল্যের পেছনে ছিল তাদের শরীরের “ইমিউন সিস্টেমের” (immune system) মিল।
তবে, সাধারণ মানুষের জন্য অঙ্গ প্রতিস্থাপন সহজ ছিল না, কারণ মানবদেহের “ইমিউন সিস্টেম” অন্য অঙ্গকে গ্রহণ করতে চাইত না। এর ফলে, প্রতিস্থাপিত অঙ্গ প্রত্যাখ্যান হওয়ার সম্ভাবনা থাকত।
১৯৬০-এর দশকে বিজ্ঞানীরা “ইমিউনোসাপ্রেসেন্ট” (immunosuppressant) ওষুধ আবিষ্কার করেন, যা শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতাকে কমিয়ে দিত এবং অঙ্গ প্রত্যাখ্যানের ঝুঁকি কমাতে সাহায্য করত।
১৯৬৭ সালে, দক্ষিণ আফ্রিকার (South Africa) সার্জন ড. ক্রিশ্চিয়ান বার্নার্ড (Dr. Christiaan Barnard) প্রথম হৃদযন্ত্র প্রতিস্থাপন করেন। এরপর থেকে এই চিকিৎসা পদ্ধতি আরও জনপ্রিয়তা লাভ করে।
ধীরে ধীরে যকৃত (liver), ফুসফুস (lung), অগ্ন্যাশয় (pancreas) সহ আরও বিভিন্ন অঙ্গ প্রতিস্থাপন করা সম্ভব হয়েছে।
অঙ্গ প্রতিস্থাপনে সাফল্যের হার বাড়ানোর জন্য বিজ্ঞানীরা সব সময়ই নতুন পথ খুঁজেছেন। মস্তিষ্কের মৃত ব্যক্তির (brain-dead donor) অঙ্গ ব্যবহারের ধারণা এক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।
১৯৬৮ সালে, হার্ভার্ড মেডিকেল স্কুলের (Harvard Medical School) একটি কমিটি মস্তিষ্কের কার্যকারিতা বন্ধ হয়ে যাওয়াকে মৃত্যুর নতুন সংজ্ঞা হিসেবে চিহ্নিত করে, যা অঙ্গ সংগ্রহের পথকে সুগম করে।
সাম্প্রতিক বছরগুলোতে, “জেনোট্রান্সপ্ল্যান্টেশন” (xenotransplantation) – অর্থাৎ, প্রাণী থেকে মানুষের শরীরে অঙ্গ প্রতিস্থাপনের সম্ভাবনা নিয়ে নতুন করে গবেষণা শুরু হয়েছে। বিজ্ঞানীরা শূকর (pig) থেকে অঙ্গ নিয়ে মানুষের শরীরে প্রতিস্থাপনের চেষ্টা করছেন, কারণ শূকরের অঙ্গ মানুষের শরীরের জন্য উপযুক্ত হতে পারে।
এক্ষেত্রে “জিন এডিটিং” (gene editing) প্রযুক্তি ব্যবহার করে শূকরের জিন পরিবর্তন করা হচ্ছে, যাতে মানুষের শরীর সহজে সেই অঙ্গ গ্রহণ করে।
২০২১ সালে, যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্ক ইউনিভার্সিটির (New York University) চিকিৎসকরা একটি “জিন-এডিটেড” শূকরের কিডনি (genetically engineered pig kidney) মস্তিষ্কের মৃত রোগীর শরীরে প্রতিস্থাপন করেন। এই পরীক্ষা সফল হওয়ার পর, ২০২২ সালে মেরিল্যান্ডের (Maryland) একটি হাসপাতালে প্রথম একজন জীবিত মানুষের শরীরে শূকরের হৃদযন্ত্র প্রতিস্থাপন করা হয়।
অঙ্গ প্রতিস্থাপনের ভবিষ্যৎ অত্যন্ত উজ্জ্বল। বিজ্ঞানীরা এখন “ব্যক্তিগত অঙ্গ” (personalized organs) তৈরি করার চেষ্টা করছেন, যেখানে রোগীর শরীরের কোষ ব্যবহার করে নতুন অঙ্গ তৈরি করা হবে। এর ফলে, রোগীকে “ইমিউনোসাপ্রেসেন্ট” ওষুধ সেবন করতে হবে না।
বাংলাদেশেও অঙ্গ প্রতিস্থাপনের প্রয়োজনীয়তা বাড়ছে। সরকারি ও বেসরকারি পর্যায়ে এ বিষয়ে সচেতনতা বৃদ্ধি এবং প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করা হচ্ছে। দেশের মানুষের জীবন বাঁচাতে অঙ্গ প্রতিস্থাপন একটি গুরুত্বপূর্ণ চিকিৎসা পদ্ধতি।
তথ্য সূত্র: সিএনএন (CNN)