যুক্তরাষ্ট্রের একটি স্বনামধন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন গবেষক, পরিবেশ দূষণ এবং জাতিগত বৈষম্য বিষয়ক গবেষণার ওপর কর্তৃপক্ষের ‘সেন্সরশিপ’-এর প্রতিবাদে পদত্যাগ করেছেন।
ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের তুলানে’র ‘এনভায়রনমেন্টাল ল’ ক্লিনিকের পরিচালক কিম্বার্লি টরেল বুধবার পদত্যাগ করেন। তাঁর অভিযোগ, লুইজিয়ানার পেট্রোকেমিক্যাল শিল্পের স্বাস্থ্যগত প্রভাব এবং শ্রমিক নিয়োগে জাতিগত বৈষম্য নিয়ে গবেষণা করার কারণে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ তাঁর ওপর কথা বলার ক্ষেত্রে বিধিনিষেধ আরোপ করে।
টরেলের পদত্যাগপত্রে উল্লেখ করা হয়েছে, বিশ্ববিদ্যালয়ের নেতারা লুইজিয়ানার রিপাবলিকান গভর্নর জেফ ল্যান্ড্রির মন রাখতে একাডেমিক স্বাধীনতাকে বিসর্জন দিচ্ছেন।
তিনি আরও জানান, ক্লিনিকটিকে কার্যত ‘মুখ বন্ধ রাখার নির্দেশ’ দেওয়া হয়েছিল, যার কারণে তিনি তাঁর গবেষণা সম্পর্কে প্রকাশ্যে কোনো মন্তব্য করতে পারতেন না।
সংবাদ সংস্থা অ্যাসোসিয়েটেড প্রেসের (এপি) হাতে আসা ইমেইল থেকে জানা যায়, বিশ্ববিদ্যালয়ের শীর্ষস্থানীয় কর্মকর্তারা মনে করেন, ল’ ক্লিনিকের কাজ বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি পুনর্গঠন প্রকল্পের জন্য ‘বাধা’ হয়ে দাঁড়াচ্ছিল।
কারণ, এই প্রকল্পের জন্য রাজ্য ও বেসরকারি তহবিল প্রয়োজন ছিল।
ক্লিনিকটি মূলত পেট্রোকেমিক্যাল শিল্পের বিরুদ্ধে লড়াই করা স্থানীয় বাসিন্দাদের প্রতিনিধিত্ব করে।
গভর্নর ল্যান্ড্রির মুখপাত্র কেট কেলি অবশ্য বলেছেন, গভর্নর রাজ্য তহবিল বন্ধ করার কোনো হুমকি দেননি।
টরেল তাঁর পদত্যাগপত্রে লিখেছেন, “আমি আর চুপ থাকতে পারি না, যখন দেখছি বিশ্ববিদ্যালয় রাজনৈতিক স্বার্থ রক্ষার জন্য একাডেমিক অখণ্ডতাকে বিসর্জন দিচ্ছে।
আমাদের কাজ খুবই গুরুত্বপূর্ণ, আর এখানে ঝুঁকি অনেক বেশি।
বিশেষ স্বার্থান্বেষী মহলেরা যেন গবেষণার স্থান দখল করতে না পারে, তা নিশ্চিত করতে আমি নীরব থাকতে পারি না।”
বিশ্ববিদ্যালয়ের মুখপাত্র মাইকেল স্ট্রেকার এক বিবৃতিতে জানান, বিশ্ববিদ্যালয় ‘একাডেমিক স্বাধীনতা’ এবং ল’ ক্লিনিকের শিক্ষাগত মূল্যের প্রতি সম্পূর্ণরূপে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ।
তবে তিনি ‘কর্মীদের বিষয়’ নিয়ে কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি।
লুইজিয়ানার মিসিসিপি নদীর তীরবর্তী প্রায় ১৩৭ কিলোমিটার দীর্ঘ এলাকা, যা পরিবেশবাদীদের কাছে ‘ক্যান্সার অ্যালে’ নামে পরিচিত, সেখানকার বাসিন্দাদের অনেকেই এই ক্লিনিকের ক্লায়েন্ট।
তুলানে বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন অনুষদের ডিন মার্সিলিন বার্ক মে মাসের ৪ তারিখে ক্লিনিকের কর্মীদের উদ্দেশে লেখা এক ইমেইলে জানান, বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রেসিডেন্ট মিশেল ফিটস উদ্বিগ্ন ছিলেন যে, ক্লিনিকের কাজের কারণে নিউ অরলিন্সের ঐতিহাসিক চ্যারিটি হাসপাতালের পুনর্গঠন প্রকল্পের সমর্থন কমে যেতে পারে।
এই প্রকল্পের জন্য শহরের সম্প্রসারণ প্রয়োজন ছিল।
বার্ক আরও লেখেন, “নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি ও প্রধান দাতারা ক্লিনিককে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতি এবং বিশেষ করে এই প্রকল্পের প্রতি তাঁদের সমর্থন দেওয়ার ক্ষেত্রে একটি বাধা হিসেবে দেখছেন।”
টরেল তাঁর পদত্যাগপত্রে লিখেছেন, তাঁকে জানানো হয়েছিল যে গভর্নর বিশ্ববিদ্যালয়ের সম্প্রসারণ প্রকল্পের জন্য কোনো রাজ্য তহবিল অনুমোদন করতে রাজি ছিলেন না, যতক্ষণ না বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রেসিডেন্ট ক্লিনিকটির বিষয়ে ‘কিছু একটা করেন’।
২০২২ সালে টরেলের সহ-সম্পাদিত একটি গবেষণায় দেখা যায়, লুইজিয়ানার কৃষ্ণাঙ্গ ও দরিদ্র জনগোষ্ঠীর মধ্যে ক্যান্সারের হার বেশি।
গত বছর প্রকাশিত তাঁর আরেকটি গবেষণায় লুইজিয়ানায় বিষাক্ত বায়ু দূষণ এবং অকাল জন্ম ও কম ওজনের শিশুদের মধ্যে যোগসূত্র খুঁজে পাওয়া যায়।
এপ্রিল মাসে প্রকাশিত এক গবেষণায় দেখা যায়, লুইজিয়ানায় পেট্রোকেমিক্যাল শিল্পে শ্বেতাঙ্গদের তুলনায় কৃষ্ণাঙ্গরা অনেক কম চাকরি পান, যদিও তাঁদের প্রশিক্ষণ ও শিক্ষার স্তর প্রায় একই ছিল।
এপ্রিল মাসের ওই গবেষণার ফলাফলের সংবাদ প্রকাশের পরপরই তুলানে বিশ্ববিদ্যালয়ের নেতারা লুইজিয়ানার নির্বাচিত কর্মকর্তাদের সঙ্গে দেখা করতে যান, বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন প্রকল্পের জন্য সমর্থন আদায়ের লক্ষ্যে।
এর কিছুক্ষণ পরেই ডিন বার্ক ক্লিনিকের কর্মীদের জানান, সামাজিক মাধ্যম এবং মিডিয়া ইন্টারভিউসহ ‘সকল প্রকার বহিরাগত যোগাযোগ’ তাঁর অনুমোদনক্রমে হতে হবে।
মে মাসের ইমেইল থেকে জানা যায়, টরেলের বিভিন্ন মিডিয়া অনুরোধ, পত্রালাপ এবং বক্তৃতা দেওয়ার অনুমতি প্রত্যাখ্যান করেছিলেন বার্ক, কারণ এগুলোকে তিনি ‘চাকরির অপরিহার্য কাজ’ হিসেবে মনে করেননি।
মে মাসের ১২ তারিখে টরেল, তাঁর একাডেমিক স্বাধীনতা লঙ্ঘিত হয়েছে এই অভিযোগ করে, কলেজগুলোর স্বীকৃতি প্রদানকারী সংস্থা সাউদার্ন অ্যাসোসিয়েশন অফ কলেজস অ্যান্ড স্কুলস কমিশন অন কলেজেস-এর কাছে অভিযোগ করেন।
তবে সংস্থাটি এ বিষয়ে কোনো মন্তব্য করেনি।
এপি’র হাতে আসা ২১ মে’র একটি অডিও রেকর্ডিংয়ে প্রভোস্ট রবিন ফরম্যানকে বলতে শোনা যায়, এপ্রিল মাসে নির্বাচিত কর্মকর্তাদের সঙ্গে বৈঠকের সময় তুলানে কর্তৃপক্ষের কাছে জানতে চাওয়া হয়েছিল, কেন ‘তুলানে রাসায়নিক শিল্পকে সম্প্রদায়ের জন্য ক্ষতিকর হিসেবে চিহ্নিত করেছে’।
এতে অন্যরা ‘লজ্জিত ও অস্বস্তিতে’ পড়েছিলেন।
বার্ক এক ইমেইলে জানান, বিশ্ববিদ্যালয়ের নেতারা একটি প্রেস বিজ্ঞপ্তি নিয়ে উদ্বিগ্ন ছিলেন, যেখানে টরেলের ক্লিনিকের প্রতিনিধিত্ব করা একজন কমিউনিটি অ্যাক্টিভিস্টকে উদ্ধৃত করে বলা হয়েছিল যে, পেট্রোকেমিক্যাল কোম্পানিগুলো ‘মানুষের চেয়ে মুনাফাকে বেশি গুরুত্ব দেয়’।
বার্ক উল্লেখ করেন, প্রেসিডেন্ট ফিটস ক্লিনিকের বিজ্ঞানভিত্তিক অ্যাডভোকেসি প্রোগ্রাম এবং বিশেষ করে টরেলের কাজ নিয়ে উদ্বিগ্ন ছিলেন, যা তাঁর মতে ‘লবিংয়ের দিকে চলে গিয়েছিল’।
বার্ক আরও জানান, ফিটস জানতে চেয়েছিলেন ‘জাতিগত বৈষম্য বিষয়ক গবেষণা কীভাবে সরাসরি ক্লায়েন্ট প্রতিনিধিত্বের সঙ্গে সম্পর্কিত’।
ক্লিনিকটি একটি প্রস্তাবিত রাসায়নিক কারখানার বিরুদ্ধে একটি আইনি আবেদনে এই গবেষণাটি উল্লেখ করে, যেখানে যুক্তি দেওয়া হয়েছে যে, এর ফলে প্রধানত কৃষ্ণাঙ্গ অধ্যুষিত একটি সম্প্রদায়ের ওপর দূষণের বোঝা বাড়বে এবং তারা ন্যায্য সংখ্যক চাকরির সুযোগ থেকে বঞ্চিত হবে।
ক্লিনিকের বার্ষিক প্রতিবেদনে একটি ঐতিহাসিক কৃষ্ণাঙ্গ সম্প্রদায়ের বাসিন্দাদের একটি দল কর্তৃক একটি বিশাল শস্য টার্মিনাল নির্মাণ বন্ধ করার বিষয়টি তুলে ধরা হয়, যা তাঁদের বাড়ির ৩০০ ফুটের মধ্যে তৈরি হওয়ার কথা ছিল।
বার্কের মতে, প্রভোস্ট ক্লিনিকের বার্ষিক প্রতিবেদনটিকে ‘উন্নয়ন বন্ধ করে দেওয়ার’ কৃতিত্ব হিসেবে দেখেছিলেন।
টরেল তাঁর পদত্যাগপত্রে সহকর্মীদের সতর্ক করে বলেন, তিনি মনে করেন তুলানে’র নেতারা ‘তাঁদের নিজস্ব সংকীর্ণ স্বার্থ হাসিলের জন্য জ্ঞান, শিক্ষা এবং বৃহত্তর মঙ্গলের নীতিগুলো ত্যাগ করেছেন’।
তথ্য সূত্র: সিএনএন