শিরোনাম: পরিবেশ সুরক্ষার পথে: যুক্তরাজ্যের স্বাস্থ্যখাতে কার্বন নিঃসরণ হ্রাস এবং জনগণের স্বাস্থ্য সুরক্ষা
বর্তমান বিশ্বে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব বাড়ছে, যা জনস্বাস্থ্যসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে মারাত্মক হুমকি সৃষ্টি করছে। এমন পরিস্থিতিতে, যুক্তরাজ্যের ন্যাশনাল হেলথ সার্ভিস (NHS) তাদের কার্বন নিঃসরণ কমিয়ে পরিবেশ সুরক্ষার পাশাপাশি জনগণের স্বাস্থ্য সুরক্ষায় এক গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ নিয়েছে।
সম্প্রতি, নটিংহ্যামের কুইনস মেডিকেল সেন্টারে (QMC) পুরনো জানালা পরিবর্তন করে নতুন ডাবল-গ্লাজড জানালা স্থাপন করা হয়েছে, যা তাদের শক্তি সাশ্রয়ী প্রকল্পের প্রথম ধাপ। এই প্রকল্পের লক্ষ্য হলো ২০৪০ সালের মধ্যে হাসপাতালটিকে কার্বন নিরপেক্ষ করা।
চিকিৎসকদের মতে, জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে সৃষ্ট বায়ু দূষণ হৃদরোগ, স্ট্রোক, ফুসফুসের ক্যান্সার এবং অ্যাজমার মতো রোগের ঝুঁকি বাড়ায়। NHS একদিকে যেমন এসব রোগীদের চিকিৎসা করে, তেমনি এটি কার্বন নিঃসরণেরও একটি প্রধান উৎস।
ইংল্যান্ডে NHS প্রায় ৪% কার্বন নিঃসরণের জন্য দায়ী। পুরনো ভবন এবং অতিরিক্ত খরচ এই সমস্যাকে আরও জটিল করে তুলেছে।
এই সমস্যা সমাধানে সরকার NHS-কে ২০৪০ সালের মধ্যে সরাসরি কার্বন নিঃসরণ শূন্যের কোঠায় নামিয়ে আনার জন্য একটি আইনগত বাধ্যবাধকতা দিয়েছে। QMC-এর সাথে E.ON-এর মতো সংস্থাগুলো কাজ করছে, যা হাসপাতালের শক্তি সাশ্রয়ে বিভিন্ন প্রযুক্তি স্থাপন করছে।
জানালা পরিবর্তনের পাশাপাশি, E.ON একটি ১৫ মিলিয়ন পাউন্ডের এনার্জি সেন্টার তৈরি ও পরিচালনা করবে, যা হাসপাতালের জন্য পরিবেশবান্ধব উপায়ে গরম ও ঠান্ডা রাখার ব্যবস্থা করবে। এই নতুন এনার্জি সেন্টার প্রাকৃতিক গ্যাস ব্যবহার না করে, বাতাস এবং ভূগর্ভ থেকে তাপ আহরণ করে, যা বছরে ১০,০০০ টন কার্বন নিঃসরণ কমাতে সাহায্য করবে।
এটি ২,২০০ টির বেশি গাড়ি রাস্তা থেকে সরিয়ে নেওয়ার সমান। এছাড়াও, এটি হাসপাতালের পরিচালন খরচ কমাবে এবং রোগী ও কর্মীদের জন্য আরামদায়ক পরিবেশ তৈরি করবে।
শুধু হাসপাতাল নয়, যুক্তরাজ্যের অনেক মানুষ এখনো শীতকালে ঘর গরম রাখার মতো প্রয়োজনীয় সুবিধা থেকে বঞ্চিত। দেশটির প্রায় সাতজনে একজন জ্বালানি দারিদ্র্যের শিকার, যার ফলে প্রতি বছর প্রায় ১০,০০০ মানুষের মৃত্যু হয়।
ঠান্ডা বাড়িতে বসবাস করা শুধু শারীরিক স্বাস্থ্যের ওপরই প্রভাব ফেলে না, বরং মানসিক স্বাস্থ্যকেও ক্ষতিগ্রস্ত করে। নাগরিকদের পরামর্শ বিষয়ক একটি সংস্থার মতে, যুক্তরাজ্যের দুর্বলভাবেinsulation করা বাড়িগুলোকে উন্নত করলে স্বাস্থ্যখাতে বছরে প্রায় ২ বিলিয়ন পাউন্ড সাশ্রয় করা যেতে পারে।
ওয়েস্ট মিডল্যান্ডসের চারটি NHS ট্রাস্টের সমন্বয়ে গঠিত ফাউন্ডেশন গ্রুপের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা, গ্লেন বার্লি বলেন, তাদের কমিউনিটি কর্মীরা প্রায়ই বাড়ি পরিদর্শনের সময় এই সমস্যাগুলো দেখতে পান। বয়স্ক রোগীদের জরুরি অবস্থার মূল কারণগুলোর মধ্যে অন্যতম হলো পর্যাপ্ত গরম না থাকা, খাবার গ্রহণ করতে না পারা এবং সামগ্রিক সুস্থতা বজায় রাখতে অক্ষমতা।
এই সমস্যা সমাধানে বিভিন্ন পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। সরকার-নির্ধারিত স্কিমের মাধ্যমে এনার্জি কোম্পানিগুলো গত এক দশকে ২০ লক্ষেরও বেশি বাড়ির উন্নতি করেছে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য একটি হলো ‘হোমস ফর লিভিং’ উদ্যোগ, যা বয়স্ক ব্যক্তিদের জীবনযাত্রার মান উন্নত করতে সহায়তা করে।
এই প্রকল্পের মাধ্যমে, স্বাধীনতা, সুস্থতা এবং চলাফেরার সুবিধার ওপর জোর দেওয়া হয়েছে। এছাড়াও, E.ON-এর বিদ্যমান স্কিমের অধীনে বিনামূল্যে বা আংশিকভাবে অর্থায়িত home solutions যেমন – insulation, solar panels ও air source heat pumps-এর ব্যবস্থা করা হয়েছে।
নিউক্যাসল ইউনিভার্সিটির সঙ্গে কাজ করে, E.ON গবেষণা করে দেখেছে যে, এই ধরনের উদ্যোগে শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্যের উল্লেখযোগ্য উন্নতি হয়। অংশগ্রহণকারীদের মধ্যে ৫০% একাকিত্বের অনুভূতি হ্রাসের কথা জানিয়েছেন।
এছাড়া, ১৪% নির্ভরশীল ব্যক্তি তাদের আগের স্বাধীনতা ফিরে পেয়েছেন। E.ON-এর মতে, এই প্রোগ্রামটি সারা ইংল্যান্ডে আরও বিস্তৃত করলে স্বাস্থ্য ও সামাজিক সুরক্ষা খাতে ১.৭ বিলিয়ন পাউন্ড সাশ্রয় হতে পারে।
QMC-এর প্রধান মাইক সরোকা জানান, তাদের সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ ছিল হাসপাতাল চালু রেখে এই ধরনের সংস্কার কাজ চালিয়ে যাওয়া। তিনি আরও বলেন, এই ধরনের প্রকল্পের সফলতার জন্য হাসপাতালের সকল বিভাগের সহযোগিতা প্রয়োজন।
এ থেকে বোঝা যায়, পরিবেশ সুরক্ষার পাশাপাশি জনস্বাস্থ্য সুরক্ষায় NHS-এর এই উদ্যোগ একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ। একইসঙ্গে, বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে এমন পরিবেশ-বান্ধব এবং স্বাস্থ্যকর উদ্যোগ নেওয়া যেতে পারে, যা দেশের মানুষের জীবনযাত্রার মান উন্নয়নে সহায়ক হবে।
তথ্য সূত্র: The Guardian