গাজায় ইসরায়েলের নতুন সামরিক অভিযান: ‘অপারেশন গিদোন’স চ্যারিয়টস’
গাজা উপত্যকায় ইসরায়েলি সামরিক বাহিনী নতুন করে ব্যাপক স্থল অভিযান শুরু করেছে। ‘অপারেশন গিদোন’স চ্যারিয়টস’ নামের এই অভিযানের ফলে সেখানকার পরিস্থিতি আরও ভয়াবহ রূপ নিয়েছে। গত কয়েক সপ্তাহে ইসরায়েলি বিমান হামলায় শত শত ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছে, যার ফলস্বরূপ গাজার স্বাস্থ্য পরিষেবা মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।
খবর অনুযায়ী, এই অভিযান এমন সময় শুরু হলো যখন ইসরায়েল ও হামাসের মধ্যে আলোচনার জন্য কাতারের রাজধানী দোহায় বৈঠক চলছে।
জানা গেছে, এই অভিযানের মূল উদ্দেশ্য হলো গাজা ভূখণ্ডে ইসরায়েলের ‘নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা’ করা। ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু বলেছেন, হামাসকে নির্মূল করা এবং গাজায় আটক জিম্মিদের মুক্ত করাই তাদের লক্ষ্য। তবে নেতানিয়াহুর এই পদক্ষেপের তীব্র সমালোচনা করেছেন ইসরায়েলের অনেক নাগরিক এবং জিম্মিদের পরিবার।
তাদের অভিযোগ, জিম্মিদের ফিরিয়ে আনার ক্ষেত্রে তিনি যথেষ্ট গুরুত্ব দিচ্ছেন না।
অভিযান শুরুর আগে নেতানিয়াহুর একটি বক্তব্য ফাঁস হয়েছে, যেখানে তিনি গাজার ফিলিস্তিনিদের এলাকা ছাড়তে বাধ্য করার কথা বলেছিলেন। তিনি বলেন, ‘আমরা আরও বেশি সংখ্যক ঘরবাড়ি ধ্বংস করছি। তাদের ফিরে যাওয়ার আর কোনো জায়গা নেই। গাজাবাসীর একমাত্র গন্তব্য হবে গাজা উপত্যকার বাইরে চলে যাওয়া।’
রবিবার থেকে শুরু হওয়া এই অভিযানে এ পর্যন্ত ১৪৪ জনের বেশি ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছে। এর মধ্যে শুধু উত্তর গাজাতেই নিহত হয়েছেন ৪২ জন। এদের মধ্যে পাঁচজন সাংবাদিকও রয়েছেন। খান ইউনিস গভর্নরেটের আল-মাওয়াসি এলাকায় বাস্তুচ্যুত ফিলিস্তিনিদের একটি তাঁবুতে ইসরায়েলি বিমান হামলায় কমপক্ষে ৩৬ জন নিহত হয়েছে এবং আহত হয়েছে শতাধিক।
গত এক সপ্তাহে ইসরায়েল গাজার ৬৭০টির বেশি স্থানে হামলা চালিয়েছে। ইসরায়েল জানিয়েছে, তারা হামাসের স্থাপনাগুলো লক্ষ্য করে হামলা চালিয়েছে। যদিও মানবাধিকার সংস্থাগুলো বলছে, ইসরায়েল নির্বিচারে বেসামরিক নাগরিকদের ওপর হামলা চালাচ্ছে।
যুদ্ধের শুরু থেকে এ পর্যন্ত গাজায় প্রায় ৫৩ হাজার ৩৩৯ জন ফিলিস্তিনি নিহত এবং ১ লাখ ২১ হাজার ৩৪ জন আহত হয়েছেন।
এই পরিস্থিতিতে গাজার বাসিন্দারা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে তাদের শেষ পোস্ট হতে পারে—এমন আশঙ্কা প্রকাশ করছেন। সোমবার ইসরায়েলি সামরিক বাহিনী খান ইউনিস শহর থেকে বাসিন্দাদের সরিয়ে যাওয়ার নির্দেশ দিয়েছে এবং সেখানে ‘নজিরবিহীন হামলা’ চালানোর ঘোষণা দিয়েছে।
চিকিৎসা কর্মীদের মতে, ইসরায়েলের এই পদক্ষেপ হাসপাতালের বিরুদ্ধে একটি ‘পরিকল্পিত ব্যবস্থা’। গাজার হাসপাতালের মহাপরিচালক মোহাম্মদ জাকুত এই বিষয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন। ইতোমধ্যেই উত্তর গাজার ইন্দোনেশীয় হাসপাতাল এবং আল-আওদা হাসপাতাল, ইউরোপীয় গাজা হাসপাতাল—ইসরায়েলি হামলায় অচল হয়ে পড়েছে।
হামাস এক বিবৃতিতে খান ইউনিসে বাস্তুচ্যুত ফিলিস্তিনিদের ওপর হামলার নিন্দা জানিয়ে একে ‘বর্বর অপরাধ’ হিসেবে উল্লেখ করেছে। হামাস এই ঘটনার জন্য যুক্তরাষ্ট্রের সমর্থনকে দায়ী করেছে।
গাজায় মানবিক সংকট তীব্র আকার ধারণ করেছে। খাদ্য, জ্বালানি, চিকিৎসা সামগ্রী এবং শিশুদের জন্য প্রয়োজনীয় ভ্যাকসিন সরবরাহ বন্ধ করে দিয়েছে ইসরায়েল। জাতিসংঘের তথ্যমতে, গাজার ৯০ শতাংশেরও বেশি মানুষ বাস্তুচ্যুত হয়েছে।
আন্তর্জাতিক মহল থেকে ইসরায়েলের প্রতি ত্রাণ সরবরাহ স্বাভাবিক করার জন্য চাপ সৃষ্টি করা হলেও, তার কোনো ফল হয়নি। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার প্রধান টেড্রোস আধানম গেব্রেইয়েসুস বলেছেন, ‘দুই মাস ধরে অবরোধের কারণে ২০ লাখ মানুষ অনাহারে দিন কাটাচ্ছে, যেখানে সীমান্তেই ১ লাখ ১৬ হাজার টন খাদ্য আটকে আছে।’ জাতিসংঘের তথ্য অনুযায়ী, বর্তমানে গাজার প্রতি পাঁচজনের মধ্যে একজন তীব্র খাদ্য সংকটে ভুগছে।
এছাড়া, চলতি বছর অপুষ্টির কারণে ৯ হাজার শিশু হাসপাতালে ভর্তি হয়েছে।
সংবাদ সংস্থা রয়টার্সকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে হামাসের মিডিয়া উপদেষ্টা তাহার আল-নুনু জানিয়েছেন, হামাস যুদ্ধ বন্ধ, বন্দী বিনিময়, গাজা থেকে ইসরায়েলি সেনা প্রত্যাহার এবং মানবিক সহায়তা পাঠানোর ওপর জোর দিচ্ছে।
জাতিসংঘের মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস গাজায় ইসরায়েলের এই অভিযান নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন এবং অবিলম্বে যুদ্ধবিরতির আহ্বান জানিয়েছেন। জার্মানি, ফ্রান্সসহ বিভিন্ন দেশও এই অভিযানের সমালোচনা করেছে এবং গাজায় মানবিক সহায়তা দ্রুত পাঠানোর আহ্বান জানিয়েছে।
তথ্য সূত্র: আল জাজিরা