ব্রাজিলের আমাজন বনে পটাশ খনি প্রকল্প: আদিবাসী সম্প্রদায়ের বিভেদ
বিশ্বের বৃহত্তম বৃষ্টিবন আমাজনে পটাশ উত্তোলনের একটি প্রকল্প আদিবাসী মুরা সম্প্রদায়ের মধ্যে বিভেদ সৃষ্টি করেছে। প্রায় ২৫০ কোটি মার্কিন ডলার ব্যয়ে নির্মিতব্য এই খনি প্রকল্পটি নিয়ে একদিকে যেমন স্থানীয় জনগণের জীবনযাত্রার মান উন্নত হওয়ার সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে, তেমনই পরিবেশগত ক্ষতির আশঙ্কাও বাড়ছে।
আমাজনের অরণ্যভূমি, যা শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে মুরা আদিবাসী সম্প্রদায়ের বাসস্থান, সেখানে পটাশ খনিজ পদার্থের বিশাল ভাণ্ডার রয়েছে। এই পটাশ মূলত সার তৈরিতে ব্যবহৃত হয়, যা ব্রাজিলের কৃষি অর্থনীতির জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। টরন্টো-ভিত্তিক কোম্পানি ব্রাজিল পটাশ কর্পোরেশন এই খনিজ সম্পদ উত্তোলনের পরিকল্পনা করছে। তারা জানিয়েছে, এই প্রকল্পের মাধ্যমে ব্রাজিলের সারের চাহিদার প্রায় ১৭ শতাংশ পূরণ করা সম্ভব হবে।
প্রকল্পটি বাস্তবায়িত হলে আদিবাসী মুরা সম্প্রদায়ের জীবনযাত্রায় বড় ধরনের পরিবর্তন আসবে বলে মনে করা হচ্ছে। কিছু মুরা নেতা মনে করেন, এই খনি প্রকল্প তাদের জীবনযাত্রার মান উন্নত করবে এবং দারিদ্র্য দূর করতে সহায়ক হবে। তারা স্কুল ও স্বাস্থ্যখাতে অনুদান এবং কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টিরও প্রত্যাশা করছেন।
অন্যদিকে, প্রকল্পের বিরোধিতাকারীরা পরিবেশের উপর এর সম্ভাব্য প্রভাব সম্পর্কে উদ্বিগ্ন। তাদের আশঙ্কা, খনি খননের ফলে দূষণ বাড়বে এবং আদিবাসী সম্প্রদায়ের ঐতিহ্য ও সংস্কৃতি ক্ষতিগ্রস্ত হবে। মুরা আদিবাসী নেতা ফিলিপ গ্যাব্রিয়েল মুরা বলেন, “যদি রাষ্ট্র আমাদের এবং আমাদের পূর্বপুরুষদের অস্তিত্বকে অস্বীকার করে খনি খননের পথ তৈরি করে, তাহলে আমরা আমাদের সংস্কৃতি হারাবার ঝুঁকিতে পড়ব।
প্রকল্পটি আমাজন নদীর কাছাকাছি অবস্থিত এবং এতে দুটি গভীর খাদ তৈরি করা হবে, যা মাটির ৯২০ মিটার নিচে পর্যন্ত বিস্তৃত হবে। এর মধ্যে একটি খাদ শ্রমিক ও খনিজ পরিবহনের জন্য এবং অন্যটি বায়ু চলাচলের কাজে ব্যবহৃত হবে। এছাড়া, একটি প্রক্রিয়াকরণ কেন্দ্র, বর্জ্য সংরক্ষণের স্থান, ১৩ কিলোমিটার রাস্তা এবং একটি নদীবন্দর নির্মাণের পরিকল্পনাও রয়েছে।
এই প্রকল্পের পরিবেশগত প্রভাব নিয়ে ইতিমধ্যেই উদ্বেগ সৃষ্টি হয়েছে। বিশেষ করে, খনিজ লবণ বা ব্রাইন হ্যান্ডেলিংয়ের বিষয়টি বেশ ঝুঁকিপূর্ণ। কারণ এটি এমন একটি অঞ্চলে অবস্থিত, যা বন্যাপ্রবণ। এছাড়াও, ভূগর্ভস্থ খনি খননের ফলে মাটির উপরিভাগ ধসে পড়ারও আশঙ্কা রয়েছে, যা জনবসতির জন্য মারাত্মক হতে পারে।
আদিবাসী জনগোষ্ঠীর ভূমি অধিকার এবং পরিবেশগত সুরক্ষার বিষয়টি বিবেচনায় নিয়ে ব্রাজিলের অ্যাটর্নি জেনারেলের কার্যালয় এই প্রকল্পের বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে আদালতে মামলা করেছে। অ্যাটর্নি জেনারেলের কার্যালয় বলছে, আদিবাসী সম্প্রদায়ের সঙ্গে যথাযথভাবে পরামর্শ না করেই প্রকল্পটি শুরু করা হচ্ছে এবং এতে পরিবেশগত ঝুঁকি রয়েছে। যদিও ব্রাজিল পটাশ কর্পোরেশন দাবি করেছে, তারা মুরা সম্প্রদায়ের সঙ্গে আলোচনা করেছে এবং অধিকাংশ মানুষ এই প্রকল্পের পক্ষে মত দিয়েছে।
এই প্রকল্পটি নিয়ে মুরা সম্প্রদায়ের মধ্যে বিভেদ এতটাই গভীর হয়েছে যে, তারা এখন আর একসঙ্গে মিলিত হয়ে সিদ্ধান্ত নিতে পারছে না। প্রকল্পের সমর্থকরা একটি পক্ষ গঠন করেছে এবং তারা মনে করে, খনি প্রকল্পটি তাদের জীবনযাত্রায় সমৃদ্ধি আনবে। অন্যদিকে, বিরোধিতাকারীরা তাদের ঐতিহ্য ও সংস্কৃতি রক্ষার জন্য নিজস্ব সংগঠন তৈরি করেছে।
ব্রাজিলের সরকার এই প্রকল্পটি সমর্থন করে। তাদের মতে, এটি দেশের অর্থনীতির জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কারণ, ব্রাজিল পটাশের জন্য এখনো বিদেশি বাজারের উপর নির্ভরশীল। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে সারের দাম বেড়ে যাওয়ায় এই প্রকল্পের গুরুত্ব আরও বেড়েছে।
তবে, স্থানীয় জনগণের মধ্যে বিরোধ এবং পরিবেশগত ঝুঁকি বিবেচনা করে প্রকল্পটি নিয়ে নতুন করে ভাবার প্রয়োজনীয়তা দেখা দিয়েছে। এটি একদিকে যেমন অর্থনৈতিক উন্নয়নের সুযোগ সৃষ্টি করতে পারে, তেমনই আদিবাসী সম্প্রদায়ের অধিকার ও পরিবেশের উপর বিরূপ প্রভাব ফেলতে পারে।
তথ্য সূত্র: অ্যাসোসিয়েটেড প্রেস