গাজায় বিদ্যুৎ সরবরাহ বন্ধ করে দিয়েছে ইসরায়েল। রবিবার ইসরায়েলের পক্ষ থেকে এই ঘোষণা আসার পর অবরুদ্ধ এই অঞ্চলটিতে মানবিক সংকট আরও তীব্র হওয়ার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে।
বিদ্যুতের অভাবে এখানকার খাবার পানি পরিশোধনের ব্যবস্থা মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে, কারণ সেখানকার পানি শোধনাগারগুলো বিদ্যুৎ এর ওপর নির্ভরশীল। ফিলিস্তিনের স্বাধীনতাকামী সংগঠন হামাস এই পদক্ষেপকে ‘গণ অনশন নীতি’ হিসেবে আখ্যায়িত করেছে।
গত সপ্তাহে ইসরায়েল গাজায় খাদ্য ও প্রয়োজনীয় পণ্য সরবরাহ বন্ধ করে দেয়। হামাসের সঙ্গে চলমান যুদ্ধের শুরুতেও একই ধরনের অবরোধ আরোপ করা হয়েছিল। ইসরায়েল এখন হামাসের প্রতি যুদ্ধবিরতির প্রথম ধাপের সময়সীমা বাড়ানোর জন্য চাপ সৃষ্টি করছে। প্রথম ধাপের সময়সীমা এরই মধ্যে শেষ হয়ে গেছে। ইসরায়েল চায় হামাস তাদের হাতে থাকা জিম্মিদের অর্ধেককে মুক্তি দিক, যার বিনিময়ে দীর্ঘমেয়াদি যুদ্ধবিরতির বিষয়ে আলোচনা শুরু করা হবে।
অন্যদিকে, হামাস চাইছে যুদ্ধবিরতির দ্বিতীয় ধাপের আলোচনা শুরু করতে, যেখানে গাজা থেকে অবশিষ্ট জিম্মিদের মুক্তি, ইসরায়েলি সেনা প্রত্যাহার এবং একটি স্থায়ী শান্তি প্রতিষ্ঠার বিষয়গুলো অন্তর্ভুক্ত থাকবে। ধারণা করা হচ্ছে, হামাসের হাতে বর্তমানে ২৪ জন জীবিত জিম্মি এবং আরও ৩৫ জনের মৃতদেহ রয়েছে।
হামাস হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করে বলেছে, সরবরাহ বন্ধ করার ফলে জিম্মিরা ক্ষতিগ্রস্ত হবে। রবিবার সংগঠনটি জানায়, তারা মিশরের মধ্যস্থতাকারীদের সঙ্গে যুদ্ধবিরতি নিয়ে সর্বশেষ দফা আলোচনা শেষ করেছে, তবে তাদের অবস্থানে কোনো পরিবর্তন আসেনি। তারা অবিলম্বে যুদ্ধবিরতির দ্বিতীয় ধাপ শুরুর আহ্বান জানিয়েছে।
ইসরায়েল জানিয়েছে, তারা সোমবার কাতারে একটি প্রতিনিধি দল পাঠাবে, ‘আলোচনা এগিয়ে নেওয়ার উদ্দেশ্যে’।
বিদ্যুৎ সরবরাহ বন্ধ করার আগে ইসরায়েল জানিয়েছিল, এরপর পানি এবং বিদ্যুতের সরবরাহ বন্ধ করা হতে পারে। ইসরায়েলের জ্বালানি মন্ত্রীর দেওয়া এক চিঠিতে ইসরায়েল ইলেকট্রিক কর্পোরেশনকে গাজায় বিদ্যুৎ বিক্রি বন্ধ করতে বলা হয়েছে।
গাজার অবকাঠামো ইতোমধ্যেই মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। হাসপাতালসহ অধিকাংশ স্থানে এখন জেনারেটরের মাধ্যমে বিদ্যুৎ সরবরাহ করা হচ্ছে। বিদ্যুৎ সরবরাহ বন্ধ হয়ে গেলে সেখানকার পাম্প ও পয়ঃনিষ্কাশন ব্যবস্থা মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে। ইসরায়েল ইলেকট্রিক কর্পোরেশনের এক মুখপাত্র জানিয়েছেন, তাদের জানামতে, এই মুহূর্তে কেবল একটি বর্জ্য জল শোধনাগার বিদ্যুৎ বিচ্ছিন্নতার শিকার হয়েছে।
হামাস মুখপাত্র হাজেম কাসেম এই পদক্ষেপকে ‘গণ অনশনের নীতি’ হিসেবে বর্ণনা করেছেন। তিনি বলেন, ইসরায়েল আন্তর্জাতিক আইন ও রীতিনীতিকে সম্পূর্ণ উপেক্ষা করছে। তিনি আরও বলেন, যুদ্ধ শুরুর পর থেকেই ইসরায়েল কার্যতভাবে বিদ্যুৎ সরবরাহ বন্ধ করে দিয়েছে।
সরবরাহ বন্ধের সিদ্ধান্তের জন্য ইসরায়েল তীব্র সমালোচনার শিকার হচ্ছে। জাতিসংঘের মানবাধিকার বিষয়ক কার্যালয় শুক্রবার এক বিবৃতিতে জানায়, ‘সাধারণ মানুষের জীবনধারণের জন্য প্রয়োজনীয় সামগ্রী সরবরাহ বন্ধ করা সম্মিলিত শাস্তির শামিল হতে পারে’।
আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালত (আইসিসি) গত বছর ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুর বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারির কারণ হিসেবে উল্লেখ করেছে, ইসরায়েল ‘যুদ্ধাস্ত্র হিসেবে অনশনকে ব্যবহার করেছে’। দক্ষিণ আফ্রিকা আন্তর্জাতিক বিচার আদালতে ইসরায়েলের বিরুদ্ধে গণহত্যার যে অভিযোগ এনেছে, এটি তার একটি প্রধান ভিত্তি।
ইসরায়েল এসব অভিযোগ অস্বীকার করে আসছে। তারা বলছে, তারা পর্যাপ্ত সহায়তা সরবরাহ করেছে এবং জাতিসংঘের বিতরণ করতে না পারার কারণে সংকট তৈরি হয়েছে। একইসঙ্গে তারা হামাসের বিরুদ্ধে ত্রাণ সহায়তা সরিয়ে নেওয়ার অভিযোগ করেছে।
ইয়েমেনের ইরান সমর্থিত হুতি বিদ্রোহ leader আবদুল মালিক আল-হুথি শুক্রবার হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করে বলেন, গাজায় সহায়তা পুনরায় চালু না হলে চার দিনের মধ্যে ইয়েমেনের জলসীমায় ইসরায়েল-সংযুক্ত জাহাজের ওপর হামলা আবারও শুরু করা হবে। এর আগে, হুতিরা তাদের হামলাকে গাজার ফিলিস্তিনিদের প্রতি সমর্থন হিসেবে বর্ণনা করেছিল।
যুদ্ধবিরতি বর্তমানে ইসরায়েল ও হামাসের মধ্যে হওয়া সবচেয়ে ধ্বংসাত্মক লড়াইকে স্থগিত রেখেছে। ২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর হামাসের নেতৃত্বে ইসরায়েলের দক্ষিণাঞ্চলে চালানো হামলার পর এই যুদ্ধের সূত্রপাত হয়। যুদ্ধবিরতির প্রথম ধাপে প্রায় ২ হাজার ফিলিস্তিনি বন্দীর মুক্তির বিনিময়ে ২৪ জন জীবিত জিম্মি এবং ৮ জনের মরদেহ ফেরত দেওয়া হয়।
ইসরায়েলি বাহিনী গাজার অভ্যন্তরে বাফার জোনে ফিরে গেছে। যুদ্ধের শুরুতে বাস্তুচ্যুত হওয়া কয়েক লক্ষ ফিলিস্তিনি প্রথম বারের মতো গাজার উত্তরে ফিরতে শুরু করেছে। ইসরায়েল সরবরাহ বন্ধ করার আগে প্রতিদিন কয়েকশ’ ট্রাক ত্রাণ সামগ্রী প্রবেশ করছিল।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের একজন দূত হামাসের সঙ্গে আলোচনার কথা জানিয়েছেন।
হোয়াইট হাউস বুধবার হামাসের সঙ্গে সরাসরি আলোচনার বিষয়টি নিশ্চিত করেছে। রবিবার দূত অ্যাডাম বোয়েলার ইসরায়েলি সম্প্রচারমাধ্যম কান-কে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে জানান, হামাস ৫ থেকে ১০ বছরের জন্য যুদ্ধবিরতির প্রস্তাব দিয়েছে এবং অস্ত্র ত্যাগ করতে রাজি হয়েছে। যদিও এর আগে সংগঠনটি অস্ত্র ত্যাগ করতে রাজি ছিল না।
বোয়েলার সিএনএন-কে বলেন, ‘আমার মনে হয়, দীর্ঘমেয়াদী যুদ্ধবিরতির মতো কিছু একটা হতে পারে, যেখানে আমরা বন্দীদের ক্ষমা করব, হামাস তাদের অস্ত্র জমা দেবে এবং ভবিষ্যতে তারা রাজনৈতিক দলের অংশ হবে না— এমনটা হতে পারে। আমার মনে হয়, এটা খুব কাছাকাছি বাস্তবতায় পৌঁছেছে।’
হামাসের সঙ্গে পুনরায় কথা বলবেন কিনা জানতে চাইলে বোয়েলার বলেন, ‘জানি না’।
তিনি আরও যোগ করেন, ‘আমার মনে হয় কয়েক সপ্তাহের মধ্যে কিছু একটা হতে পারে’। তিনি আশা প্রকাশ করেন, এমন একটি চুক্তি হবে যেখানে কেবল আমেরিকান নয়, সকল জিম্মিকে মুক্তি দেওয়া হবে। বোয়েলার জানিয়েছেন, গাজায় আটক পাঁচজন আমেরিকান জিম্মির মধ্যে চারজন মারা গেছেন, আর একজন এখনও জীবিত আছেন। তার নাম এডান আলেকজান্ডার।
রবিবার হামাস আলোচনায় অংশগ্রহণের কথা উল্লেখ করেনি, তবে ফিলিস্তিনিদের প্রেসিডেন্ট ও আইনসভা নির্বাচনের আগ পর্যন্ত গাজা পরিচালনার জন্য টেকনোক্র্যাটদের সমন্বয়ে একটি স্বাধীন কমিটি গঠনের প্রস্তাবের প্রতি সমর্থন জানিয়েছে।
২০২৩ সালের অক্টোবরে হামাসের হামলায় ইসরায়েলের ভেতরে প্রায় ১,২০০ জন নিহত হয়, যাদের অধিকাংশই ছিলেন বেসামরিক নাগরিক। এছাড়াও ২৫১ জনকে জিম্মি করা হয়। যুদ্ধবিরতি চুক্তি বা অন্যান্য ব্যবস্থার মাধ্যমে তাদের অধিকাংশই মুক্তি পেয়েছেন।
গাজার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী, ইসরায়েলি সামরিক অভিযানে গাজায় এখন পর্যন্ত প্রায় ৪৮,০০০ এর বেশি ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছে, যাদের অধিকাংশই নারী ও শিশু। তবে নিহতদের মধ্যে কতজন যোদ্ধা ছিল, সে বিষয়ে মন্ত্রণালয় কোনো তথ্য জানায়নি।
গাজায় সরবরাহ বন্ধের কারণে রমজান মাসে ফিলিস্তিনিরা প্রয়োজনীয় জিনিসের তীব্র মূল্যবৃদ্ধি এবং ঘাটতির শিকার হচ্ছে।
খান ইউনিসের বাসিন্দা ফারেস আল-কাইসি বলেন, ‘যুদ্ধবিরতি শুরুর পর পরিস্থিতি কিছুটা উন্নতি হয়েছে। কিন্তু এর আগে পরিস্থিতি খুবই খারাপ ছিল। আল্লাহর কসম, মানুষ ক্ষুধা মেটাতে পারছিল না।’
তথ্য সূত্র: অ্যাসোসিয়েটেড প্রেস