ডোনাল্ড ট্রাম্পের আমলে যুক্তরাষ্ট্র কর্তৃক ইস্পাত ও অ্যালুমিনিয়াম আমদানির ওপর শুল্ক আরোপের জেরে বিশ্বজুড়ে যে প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয়েছে, তার ঢেউ লেগেছে বাণিজ্য অঙ্গনে। যুক্তরাষ্ট্র সরকার এই পদক্ষেপ নেওয়ার পর এর শিকার হওয়া দেশগুলো হয় প্রতিশোধমূলক শুল্ক আরোপ করেছে, নয়তো শুল্ক মওকুফের চেষ্টা করছে, অথবা দ্বিপাক্ষিক আলোচনার মাধ্যমে সমাধানের পথ খুঁজছে। এই পরিস্থিতিতে বাংলাদেশের জন্য উদ্বেগের কারণ হলো, বিশ্ব অর্থনীতির এই ডামাডোলে দেশের ব্যবসা-বাণিজ্য ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার আশঙ্কা।
যুক্তরাষ্ট্রের এই সিদ্ধান্তের ফলে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলোর মধ্যে রয়েছে কানাডা, মেক্সিকো ও ইউরোপীয় ইউনিয়ন। আন্তর্জাতিক বাণিজ্য প্রশাসন সূত্রে জানা যায়, যুক্তরাষ্ট্র ইস্পাত আমদানির ক্ষেত্রে শীর্ষ তিন সরবরাহকারী দেশ হলো কানাডা, ব্রাজিল ও মেক্সিকো। এই তিনটি দেশ একাই যুক্তরাষ্ট্রের মোট আমদানির প্রায় ৪৯ শতাংশ সরবরাহ করে থাকে। এছাড়া, দক্ষিণ কোরিয়া, ভিয়েতনাম, জাপান, জার্মানি, তাইওয়ান, নেদারল্যান্ডস ও চীনও উল্লেখযোগ্য পরিমাণ ইস্পাত সরবরাহ করে। অ্যালুমিনিয়ামের ক্ষেত্রে কানাডা, সংযুক্ত আরব আমিরাত, রাশিয়া ও মেক্সিকো প্রধান সরবরাহকারী। এখানেও কানাডার আধিপত্য বেশি, যা যুক্তরাষ্ট্রের মোট অ্যালুমিনিয়াম আমদানির প্রায় ৪০ শতাংশ।
এই শুল্ক যুদ্ধের সরাসরি প্রভাব পড়বে যুক্তরাষ্ট্রের উৎপাদনকারী ও ভোক্তাদের ওপর। কারণ, ইস্পাত ও অ্যালুমিনিয়াম—উভয়ই গৃহস্থালীর সরঞ্জাম, গাড়ি, বিমান, ফোন এবং বিভিন্ন অবকাঠামো নির্মাণের জন্য অপরিহার্য উপাদান। নির্মাণ খাতে ব্যবহৃত ইস্পাত, মোট ইস্পাত আমদানির এক-তৃতীয়াংশ। ফলে বিমানবন্দরের মতো গুরুত্বপূর্ণ প্রকল্পের খরচ বাড়বে। অন্যদিকে, হালকা ও ক্ষয়রোধী অ্যালুমিনিয়াম, স্বয়ংচালিত ও মহাকাশ শিল্পের পাশাপাশি খাদ্য ও পানীয়ের মোড়ক তৈরিতেও গুরুত্বপূর্ণ।
কানাডার প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডো এই শুল্ককে ‘অযৌক্তিক’ এবং ‘বোকার মতো কাজ’ হিসেবে অভিহিত করেছেন। এর প্রতিক্রিয়ায় কানাডা, যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন পণ্যের ওপর ২৫ শতাংশ হারে শুল্ক আরোপ করেছে, যার মধ্যে ইস্পাতের ওপর ৮.৮ বিলিয়ন ডলার এবং অ্যালুমিনিয়ামের ওপর ২ বিলিয়ন ডলারের শুল্ক অন্তর্ভুক্ত। ইউরোপীয় ইউনিয়নও যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন পণ্যের ওপর পাল্টা ব্যবস্থা হিসেবে শুল্ক আরোপ করেছে। মেক্সিকো যদিও আলোচনার মাধ্যমে সমাধানের চেষ্টা করছে, তবে দেশটির কর্মকর্তারা জানিয়েছেন আলোচনা ব্যর্থ হলে তারাও প্রতিশোধমূলক শুল্ক আরোপ করতে পারে।
দক্ষিণ কোরিয়াও এই ইস্যুতে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে আলোচনার পথ বেছে নিয়েছে। দেশটির কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, তারা যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে শুল্ক মওকুফ এবং পারস্পরিক উদ্বেগের বিষয়গুলো নিয়ে আলোচনা করতে আগ্রহী। অন্যদিকে, চীন এই শুল্ককে সরাসরি অর্থনৈতিক আক্রমণ হিসেবে দেখছে এবং এর মোকাবিলায় প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেওয়ার কথা জানিয়েছে।
প্রশ্ন হলো, বাংলাদেশের জন্য এর প্রভাব কী? বিশ্ব অর্থনীতির এই টালমাটাল পরিস্থিতিতে বাংলাদেশের রপ্তানি বাণিজ্য ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। বিশেষ করে, তৈরি পোশাক, চামড়া ও পাটজাত পণ্যের মতো গুরুত্বপূর্ণ খাতে এর প্রভাব পড়তে পারে, কারণ ইস্পাত ও অ্যালুমিনিয়ামের দাম বাড়লে উৎপাদন খরচ বাড়বে, যা বিশ্ব বাজারে টিকে থাকতে সমস্যা তৈরি করতে পারে। এছাড়াও, উন্নয়নশীল দেশ হিসেবে বাংলাদেশের অবকাঠামো নির্মাণ ও বিভিন্ন উন্নয়নমূলক কর্মকাণ্ডেও এর নেতিবাচক প্রভাব পড়তে পারে। তাই, পরিস্থিতি বিবেচনা করে বাংলাদেশকে দ্রুত পদক্ষেপ নিতে হবে, যাতে বিশ্ব বাণিজ্যের এই অস্থিরতা দেশের অর্থনীতিকে ক্ষতিগ্রস্ত করতে না পারে।
তথ্য সূত্র: আল জাজিরা