মার্কিন প্রতিরক্ষা দপ্তর পেন্টাগন রাশিয়া ও চীনের মহাকাশ বিষয়ক সামরিক সক্ষমতা পরীক্ষা-নিরীক্ষণ নিয়ে গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেছে। তাদের মতে, এই দুটি দেশ আক্রমণাত্মক মহাকাশ প্রযুক্তি তৈরির চেষ্টা চালাচ্ছে, যা ভবিষ্যতে সামরিক ক্ষেত্রে গুরুতর প্রভাব ফেলতে পারে।
সম্প্রতি উভয় দেশ কর্তৃক পরিচালিত কিছু স্যাটেলাইট প্রশিক্ষণ মহড়া এর প্রমাণ বহন করে। পেন্টাগনের এক কর্মকর্তার দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, গত কয়েক সপ্তাহে রাশিয়ার স্যাটেলাইটগুলো আক্রমণ ও প্রতিরোধের কৌশল অনুশীলন করেছে।
এর মাধ্যমে তারা মহাকাশ বাহিনী বা স্পেস ফোর্সের দক্ষতা বাড়াতে চাইছে। কর্মকর্তারা আরও জানিয়েছেন, রাশিয়ার কয়েকটি স্যাটেলাইট একসঙ্গে কাজ করে কীভাবে অন্য একটি স্যাটেলাইটকে ঘিরে ধরতে পারে, তার মহড়া চালিয়েছে।
এর মাধ্যমে তারা ভবিষ্যতে শত্রুপক্ষের মহাকাশযানকে লক্ষ্যবস্তু বানানোর সক্ষমতা প্রদর্শন করেছে। রাশিয়ার মূল লক্ষ্য হলো মহাকাশে পারমাণবিক অস্ত্র স্থাপন করা।
দেশটির সাম্প্রতিক স্যাটেলাইট কার্যক্রমও মহাকাশে সম্ভাব্য সামরিক সংঘাতের ইঙ্গিত দেয়। ওই কর্মকর্তা আরও বলেন, “রাশিয়া মহাকাশে আমাদের সুবিধাগুলো কেড়ে নিতে চায় এবং তারা এর সম্ভাব্য ক্ষতির বিষয়েও মাথা ঘামাতে রাজি নয়।”
২০২১ সালে রাশিয়া একটি ক্ষেপণাস্ত্রের পরীক্ষা চালায়, যা তাদেরই একটি স্যাটেলাইট ধ্বংস করে দেয়। এর ফলে মহাকাশে বিশাল ধ্বংসস্তূপ তৈরি হয় এবং আন্তর্জাতিক মহাকাশ স্টেশনের নভোচারীদের নিরাপত্তা নিয়ে উদ্বেগ দেখা দেয়।
চীনের মহাকাশ কার্যক্রমও উদ্বেগের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। গত এক বছরে চীনও মহাকাশে অনুরূপ প্রশিক্ষণ মহড়া চালিয়েছে।
ডিসেম্বরে তারা একাধিক স্যাটেলাইটকে কাছাকাছি এনে সামরিক সক্ষমতার জানান দেয়। পেন্টাগনের কর্মকর্তাদের মতে, এটি সামরিক প্রয়োগের একটি সম্ভাব্য দিক।
চীনের তৈরি করা কো-অরবিটাল স্যাটেলাইট অন্য স্যাটেলাইটকে সরাসরি আঘাত করতে বা অকার্যকর করতে পারে। বেইজিং এমন প্রযুক্তির একটি ভাণ্ডার তৈরি করছে।
এছাড়া, তারা অ্যান্টি-স্যাটেলাইট ক্ষেপণাস্ত্র এবং লেজার বা অনুরূপ প্রযুক্তির মাধ্যমে অন্য স্যাটেলাইটের ওপর আক্রমণের প্রস্তুতি নিচ্ছে। মার্কিন কর্মকর্তারা বলছেন, চীন তাদের নিজস্ব মহাকাশ বাহিনী তৈরি করছে, প্রশিক্ষণ দিচ্ছে এবং যুক্তরাষ্ট্রের কাছ থেকে ‘চূড়ান্ত উচ্চস্থান’ দখলের জন্য প্রস্তুত হচ্ছে।
চীন এরই মধ্যে মহাকাশে তাদের প্রযুক্তিগত দক্ষতা প্রমাণ করেছে। ২০২১ সালে তারা একটি মহাকাশ থেকে উৎক্ষেপণযোগ্য হাইপারসনিক ক্ষেপণাস্ত্রের পরীক্ষা চালায়, যা যুক্তরাষ্ট্রকে হতবাক করে দেয়।
তৎকালীন শীর্ষ মার্কিন জেনারেল এটিকে “খুবই গুরুত্বপূর্ণ প্রযুক্তিগত ঘটনা” হিসেবে বর্ণনা করেন। মার্কিন স্পেস ফোর্সের কর্মকর্তারা রাশিয়া ও চীনের সামরিক সক্ষমতা বৃদ্ধির বিষয়টি নজরে রাখছেন।
তারা মনে করেন, এই দুটি দেশ যেন সামরিক সুবিধা অর্জনের জন্য যুক্তরাষ্ট্রের সম্পদ ব্যবহার করতে না পারে, সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে। যুক্তরাষ্ট্র এখনো মহাকাশে রাশিয়া ও চীনের চেয়ে এগিয়ে আছে, তবে উভয় দেশই সামরিক কার্যকারিতা বাড়াতে এবং মার্কিন প্রযুক্তির ওপর নির্ভরতা কমাতে নতুন নতুন ব্যবস্থা তৈরি করছে।
১৯৬৭ সালের ‘বহিঃমহাকাশ চুক্তি’ অনুযায়ী, মহাকাশে ব্যাপক ধ্বংসের অস্ত্র নিষিদ্ধ। কিন্তু মহাকাশ অস্ত্র প্রতিযোগিতা নিয়ে উদ্বেগ বাড়ছে, যা এই চুক্তির কার্যকারিতা নিয়ে প্রশ্ন তৈরি করেছে।
গত এপ্রিলে রাশিয়া জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদে একটি প্রস্তাবের বিরোধিতা করে, যেখানে মহাকাশে পারমাণবিক অস্ত্রের বিরোধীতা করার কথা ছিল। মার্কিন স্পেস ফোর্সের কর্মকর্তাদের মতে, চীন দ্রুত তাদের মহাকাশ সক্ষমতা বৃদ্ধি করছে, যা মার্কিন সামরিক বাহিনীকে নজরদারী ও আক্রমণের কাজে ব্যবহার করা হতে পারে।
ডিসেম্বর ২০২৪ পর্যন্ত চীনের ১,০৬০টির বেশি স্যাটেলাইট কক্ষপথে ছিল, যা যুক্তরাষ্ট্রের পরেই দ্বিতীয়। মার্কিন স্পেস ফোর্সের গোয়েন্দা বিভাগ মনে করে, চীন ভবিষ্যতে সংঘাতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করার জন্য মহাকাশের ওপর নির্ভরশীল হবে, যা দূরপাল্লার নির্ভুল আঘাত হানতে সাহায্য করবে।
ডিসেম্বর ২০২৪-এ, চীন একটি দূরসংবেদী স্যাটেলাইট উৎক্ষেপণ করে, যা মার্কিন ও মিত্র বাহিনীর ওপর নজরদারির কাজে ব্যবহার করা হতে পারে। বিভিন্ন মার্কিন স্পেস ফোর্স কর্মকর্তার মতে, “গোয়েন্দা তথ্য বলছে, সম্ভবত চীন আঞ্চলিক সংঘাতে মার্কিন সামরিক হস্তক্ষেপকে বাধা দিতে কাউন্টারস্পেস কার্যক্রমকে একটি উপায় হিসেবে বিবেচনা করে।”
তারা আরও যোগ করেন, “চীনের বিশেষজ্ঞরা ‘শত্রুর পুনরুদ্ধার এবং যোগাযোগের স্যাটেলাইট ধ্বংস করা, ক্ষতি করা এবং তাতে হস্তক্ষেপ করা’র ওপর গুরুত্ব দেন, যাতে শত্রুকে ‘অন্ধ ও বধির’ করা যায়।”
২০২৪ সালে চীন ৬৬টি সফল মহাকাশ উৎক্ষেপণ করে, যার মধ্যে ৬৭টি গোয়েন্দা, নজরদারি এবং পুনরুদ্ধার (ISR) স্যাটেলাইট স্থাপন করা হয়। তথ্য সূত্র: সিএনএন।