মহাকাশে উপগ্রহের জঞ্জাল: নতুন প্রযুক্তিতে মিলবে সমাধান?
মহাকাশ এখন ক্রমশই জনাকীর্ণ হয়ে উঠছে। মানুষের পাঠানো প্রায় ২০,০০০ এর বেশি স্যাটেলাইট বর্তমানে পৃথিবীর চারপাশে ঘুরছে, এবং আগামী কয়েক বছরে আরও হাজার হাজার স্যাটেলাইট উৎক্ষেপণের পরিকল্পনা রয়েছে।
এর মধ্যে কিছু স্যাটেলাইট ইতিমধ্যেই বায়ুমণ্ডলে পুড়ে গেছে বা সাগরে পতিত হয়েছে। তবে ১৩,০০০ এর বেশি স্যাটেলাইট এখনো সক্রিয় রয়েছে। এদের মধ্যে প্রায় এক-পঞ্চমাংশ অকেজো হয়ে মহাকাশে ঘুরে বেড়াচ্ছে, যা মূলত ‘স্পেস জাঙ্ক’ বা মহাকাশের আবর্জনা হিসেবে পরিচিত।
গত কয়েক দশকে, এই মৃত স্যাটেলাইটগুলোর মধ্যে কয়েকশ’র সংঘর্ষের ফলে কয়েক লক্ষ ক্ষুদ্র আকারের ধ্বংসাবশেষ তৈরি হয়েছে।
এই মহাকাশ-আবর্জনা সক্রিয় স্যাটেলাইট এবং আন্তর্জাতিক মহাকাশ স্টেশনের জন্য প্রতিনিয়ত সংঘর্ষের ঝুঁকি তৈরি করছে। পরিস্থিতি এতটাই গুরুতর যে, বর্তমানে বেশ কয়েকটি নজরদারি নেটওয়ার্ক সক্রিয়ভাবে হাজার হাজার বড় আকারের বস্তুর গতিবিধি পর্যবেক্ষণ করে এবং প্রয়োজন অনুযায়ী মহাকাশযানগুলোকে বিপদ থেকে সরিয়ে নেয়।
মহাকাশে বর্জ্যের এই ক্রমবর্ধমান হুমকি মোকাবিলায় একদিকে যেমন কক্ষপথে স্যাটেলাইটের দ্রুত চলাচল ক্ষমতা বাড়ানো প্রয়োজন, তেমনি কমাতে হবে আবর্জনার পরিমাণও। এই সমস্যা সমাধানে এগিয়ে এসেছে ব্রিটিশ স্টার্টআপ ম্যাগড্রাইভ।
তারা এমন একটি নতুন প্রযুক্তি তৈরি করেছে, যা কঠিন ধাতু ব্যবহার করে স্যাটেলাইটের গতি নিয়ন্ত্রণ করবে। কোম্পানিটি জানিয়েছে, এই বছরই তাদের তৈরি প্রযুক্তি প্রথমবারের মতো মহাকাশে উৎক্ষেপণ করা হবে।
ম্যাগড্রাইভের সহ-প্রতিষ্ঠাতা মার্ক স্টোকস বলেন, “আমরা এমন কিছু তৈরি করতে চেয়েছি যা মহাকাশ শিল্পে মানবজাতির জন্য গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তন আনবে, সেইসাথে আমাদের মহাকাশ-ভ্রমণের উপযোগী সভ্যতা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে সাহায্য করবে।” তার দাবি, কঠিন ধাতুর প্রপালশন সিস্টেম ব্যবহারের ফলে স্যাটেলাইটের গতিশীলতা ১০ গুণ পর্যন্ত বাড়ানো সম্ভব হবে, এবং একইসাথে প্রপালশনের জন্য প্রয়োজনীয় ভরও ১০ গুণ কমানো যাবে।
ম্যাগড্রাইভ বর্তমানে তাদের স্পেস থ্রাস্টারের তিনটি সংস্করণ তৈরির কাজ করছে। এই থ্রাস্টারগুলো কঠিন ধাতু দিয়ে তৈরি হওয়ার কারণে, ভবিষ্যতে মহাকাশে বিদ্যমান আবর্জনা ব্যবহার করে সেগুলোর জ্বালানি তৈরি করা যেতে পারে, যা একদিকে যেমন ঝুঁকি কমাবে, তেমনি জ্বালানির উৎসও হবে।
স্যাটেলাইটের গতিপথ পরিবর্তন, বায়ুমণ্ডলের ঘর্ষণের কারণে কক্ষপথ স্থিতিশীল রাখা, মহাকাশের ধ্বংসাবশেষ এড়িয়ে চলা এবং সবশেষে নিজেদের কক্ষপথ থেকে সরিয়ে আনার মতো বিভিন্ন কারণে স্যাটেলাইটের প্রপালশন সিস্টেমের প্রয়োজন হয়।
বর্তমানে, স্যাটেলাইটের প্রপালশন সিস্টেমগুলো প্রধানত রাসায়নিক বা বৈদ্যুতিক পদ্ধতিতে কাজ করে। তবে স্টোকসের মতে, উভয় পদ্ধতিরই কিছু দুর্বলতা রয়েছে।
তিনি ব্যাখ্যা করেন, “রাসায়নিক প্রপালশন সিস্টেম উচ্চ গতির ক্ষমতা সম্পন্ন হলেও এর কার্যকারিতা খুবই কম। অন্যদিকে, বৈদ্যুতিক প্রপালশন সিস্টেমগুলোর কার্যকারিতা চমৎকার, তবে গতি কম থাকে।”
ম্যাগড্রাইভ তৈরি করছে এমন একটি সিস্টেম, যেখানে একইসাথে উচ্চ গতি এবং উচ্চ কার্যকারিতা পাওয়া যাবে। স্টোকস যোগ করেন, “আমরা এমন একটি ব্যবস্থা তৈরি করছি যা বৈদ্যুতিক প্রপালশন সিস্টেমের মতো কাজ করবে, তবে এর ক্ষমতা এবং আকার উভয় দিকেই উল্লেখযোগ্য উন্নতি ঘটবে।”
ম্যাগড্রাইভের তৈরি ‘ওয়ারলক’ নামক প্রথম সিস্টেমটি ২০২৫ সালের জুন মাসে উৎক্ষেপণ করার পরিকল্পনা রয়েছে। এই সিস্টেমে বিদ্যমান বৈদ্যুতিক প্রপালশন সিস্টেমের মতোই সৌর প্যানেল ব্যবহার করে শক্তি তৈরি করা হবে।
তবে প্রচলিত বৈদ্যুতিক সিস্টেমে চাপযুক্ত গ্যাসকে আয়নিত করতে বিষাক্ত রাসায়নিক পদার্থ (যেমন: হাইড্রাজিন) ব্যবহার করা হয়, সেখানে ম্যাগড্রাইভ কঠিন ধাতু ব্যবহার করবে।
স্টোকস বলেন, “এটির অনেক সুবিধা রয়েছে।” ধাতু খুব ঘন হওয়ায় চাপযুক্ত গ্যাসের ট্যাংকের চেয়ে কম জায়গা নেয়।
সেই কারণে স্যাটেলাইট প্রস্তুতকারকদের জন্য এটি সহজ হবে। কারণ, চাপযুক্ত গ্যাস ট্যাংকগুলো তৈরি ও ব্যবহারের সময় ঝুঁকিপূর্ণ এবং ফেটে যাওয়ার সম্ভাবনা থাকে।
অন্যদিকে, ধাতু স্থিতিশীল থাকে এবং সময়ের সাথে এর কোনো পরিবর্তন হয় না। ম্যাগড্রাইভ বর্তমানে তামা ব্যবহার করছে, কারণ এটি তুলনামূলকভাবে সস্তা এবং সহজে পাওয়া যায়।
তবে স্টোকস জানিয়েছেন, যেকোনো ধাতু এই কাজে ব্যবহার করা যেতে পারে।
ধাতু আয়নিত হওয়ার পর অত্যন্ত উত্তপ্ত এবং ঘন প্লাজমা বা বিদ্যুচ্চুম্বকীয় গ্যাসে পরিণত হয়।
স্টোকস এর ব্যাখ্যা দিয়ে বলেন, “এর ফলে থ্রাস্টারের পেছন থেকে অত্যন্ত শক্তিশালী তামার প্লাজমা নির্গত হয়, যা থ্রাস্টারটিকে বিপরীত দিকে সরিয়ে নিতে সাহায্য করে।”
ভবিষ্যতে এই সিস্টেম মহাকাশের আবর্জনা থেকেও জ্বালানি সংগ্রহ করতে পারবে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
স্টোকস বলেন, “এর ফলে আমরা নতুন মহাকাশ অর্থনীতির একটি চক্র তৈরি করতে পারব, যেখানে বিদ্যমান সম্পদগুলোই ব্যবহৃত হবে।” তিনি আরও যোগ করেন, “বর্তমানে প্রতিটি স্যাটেলাইটকে পৃথিবী থেকে জ্বালানি বহন করতে হয়, যা অনেকটা স্টেশন ছাড়ার সময় নতুন একটি ট্রেন তৈরির মতো।”
ম্যাগড্রাইভ আগামী বছরের মধ্যে তাদের প্রথম বাণিজ্যিক কার্যক্রম শুরু করার পরিকল্পনা করছে। তারা বিভিন্ন ধরনের ক্লায়েন্টদের জন্য এই প্রযুক্তি সরবরাহ করতে চায়।
স্টোকস বলেন, “আমরা এমন একটি মানসম্মত যন্ত্রাংশ তৈরি করছি যা যেকোনো স্যাটেলাইটে স্থাপন করা যেতে পারে।
এর মধ্যে রয়েছে পৃথিবী পর্যবেক্ষণ, স্যাটেলাইট রক্ষণাবেক্ষণ এবং যোগাযোগসহ বিভিন্ন ধরনের অ্যাপ্লিকেশন, এবং ১০ কেজি থেকে ৪০০ কেজি পর্যন্ত ওজনের স্যাটেলাইটের জন্য এটি ব্যবহার করা যাবে।
তবে, এই প্রযুক্তিতে কিছু চ্যালেঞ্জও রয়েছে।
যুক্তরাজ্যের সাউদাম্পটন বিশ্ববিদ্যালয়ের মহাকাশ প্রকৌশল বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক মিনকোয়ান কিম, যিনি ম্যাগড্রাইভের সাথে গবেষণা প্রকল্পে যুক্ত আছেন, তিনি জানান, কঠিন ধাতু ব্যবহার করার ফলে গ্যাস বা তরল জ্বালানির তুলনায় এর সংরক্ষণ এবং পরিচালনা সহজ হবে।
এছাড়াও, এটি ব্যাপক উৎপাদনের জন্য উপযুক্ত একটি সরল নকশা সরবরাহ করে, যা বৃহৎ আকারের স্যাটেলাইট তৈরির জন্য গুরুত্বপূর্ণ।
তবে কিম আরও উল্লেখ করেন, “ধাতু জ্বালানি ব্যবহারের ক্ষেত্রে পৃষ্ঠের দূষণ একটি গুরুত্বপূর্ণ চ্যালেঞ্জ।
বিশেষ করে সৌর প্যানেল এবং অপটিক্যাল সিস্টেমের ক্ষেত্রে এর প্রভাব পড়তে পারে।” যেহেতু এই প্রক্রিয়ায় ধাতব প্লাজমা তৈরি হয়, তাই এটি সহজেই পৃষ্ঠের উপর জমা হতে পারে, যা মহাকাশযানের কর্মক্ষমতাকে প্রভাবিত করতে পারে।
স্টোকস জানান, ম্যাগড্রাইভ সিস্টেমে ধাতু সম্পূর্ণরূপে ব্যবহৃত হয় এবং এটি “বিক্ষিপ্ত নিষ্ক্রিয় উপাদানে” রূপান্তরিত হয়, যা খুবই কম গতিতে নির্গত হয় এবং অন্য কোনো বস্তুর উপর জমা হওয়ার সম্ভবনাও কম।
কিম আরও যোগ করেন, নির্ভরযোগ্য এবং স্থিতিশীল গতি তৈরি করাও একটি চ্যালেঞ্জ।
থ্রাস্টার তৈরির সময় ধাতু গরম এবং ঠান্ডা হওয়ার কারণে এর আণবিক গঠন পরিবর্তিত হতে পারে, যা জ্বালানির কার্যকারিতা কমিয়ে দিতে পারে।
এই কারণে, স্থিতিশীল গতি বজায় রাখার জন্য একটি সঠিক পর্যবেক্ষণ ও নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা প্রয়োজন হবে, যা সিস্টেমটিকে আরও জটিল করে তুলবে।
মহাকাশের আবর্জনা ব্যবহার করে জ্বালানি তৈরির বিষয়ে কিম বলেন, “এটি তাত্ত্বিকভাবে সম্ভব, তবে এতে প্রযুক্তিগত এবং আইনি জটিলতা রয়েছে।” উদাহরণস্বরূপ, জাতিসংঘের বহিরাকাশ চুক্তি অনুযায়ী, মহাকাশে উৎক্ষেপিত বস্তুর মালিকানা অপরিবর্তিত থাকে, এমনকি সেটি ধ্বংসাবশেষে পরিণত হলেও।
অর্থাৎ, স্যাটেলাইট পুনর্ব্যবহার করার আগে মূল মালিকের অনুমতি নিতে হবে।
এছাড়াও, কিছু স্যাটেলাইটে সংবেদনশীল ডেটা বা মালিকানাধীন প্রযুক্তি থাকতে পারে, যা মালিকদের কাছ থেকে অনুমতি পেতে বাধা সৃষ্টি করবে।
সবশেষে, পুনর্ব্যবহৃত স্যাটেলাইটের কারণে কোনো দুর্ঘটনা ঘটলে তার দায়ভার লঞ্চকারী দেশের উপর বর্তায়, যা আইনি জটিলতা আরও বাড়ায়।
কিমের মতে, এক্ষেত্রে কিছু ব্যবহারিক সমস্যাও রয়েছে।
তিনি বলেন, “ব্যবহারের অযোগ্য স্যাটেলাইটগুলো নিয়ন্ত্রণ করা কঠিন এবং প্রায়শই এলোমেলোভাবে ঘুরতে থাকে, যা তাদের পুনরুদ্ধার করাকে অত্যন্ত কঠিন করে তোলে।
তাদের ধরা এবং সুরক্ষিত করার জন্য জটিল কৌশল প্রয়োজন, যা এখনও প্রাথমিক পর্যায়ে রয়েছে।” তিনি আরও জানান, এই স্যাটেলাইটগুলো কেবল ধাতু দিয়ে তৈরি নয়, বরং সিলিকন এবং পলিমারের মতো উপকরণও ব্যবহার করা হয়।
ধাতব জ্বালানির গুণমান এবং বিশুদ্ধতা থ্রাস্টের কর্মক্ষমতাকে সরাসরি প্রভাবিত করে।
তাই, সংগৃহীত ধাতুর গঠন সঠিকভাবে নিয়ন্ত্রণ করা না গেলে নির্ভরযোগ্য এবং পূর্বাভাসযোগ্য থ্রাস্ট অর্জন করা কঠিন হবে।
কিমের মতে, “এর ফলস্বরূপ, মহাকাশের আবর্জনা থেকে প্রাপ্ত ধাতু হয়তো ডি-অরবিটিংয়ের মতো কম গুরুত্বপূর্ণ কৌশলের জন্য উপযুক্ত হতে পারে, তবে উচ্চ-নির্ভুলতার প্রপালশনের জন্য এটি ব্যবহার করা সম্ভব নাও হতে পারে।”
তথ্য সূত্র: সিএনএন