ট্রাম্পের শুল্ক পরিকল্পনা: বাস্তবায়নে প্রয়োজন অতিরিক্ত সময়, বিশ্ব বাণিজ্য ও বাংলাদেশের উপর প্রভাব
যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প তার পছন্দের হাতিয়ার—বিদেশি পণ্যের ওপর ব্যাপক শুল্ক আরোপের মাধ্যমে—মার্কিন উৎপাদন শিল্পকে পুনরুজ্জীবিত করতে চেয়েছিলেন।
কিন্তু তার সেই পরিকল্পনা বাস্তবায়নে সম্ভবত আরও অনেক বেশি সময় প্রয়োজন, যা তার দ্বিতীয় মেয়াদের সময়সীমার চেয়েও বেশি।
আমেরিকার শিল্পখাতকে নতুন করে সাজানো বা ‘রিইন্ডাস্ট্রিয়ালাইজেশন’ অনেক কর্মসংস্থান তৈরি করতে পারে এবং কারখানা বন্ধ হয়ে যাওয়া শিল্পাঞ্চলগুলোতে প্রাণ ফিরিয়ে আনতে পারে।
শুল্ক আরোপের ফলে কিছু ক্ষেত্রে অভ্যন্তরীণ উৎপাদনে বিনিয়োগ উৎসাহিত হতে পারে। কিন্তু অর্থনীতিবিদ ও বাণিজ্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, মার্কিন উৎপাদন শিল্পের উল্লেখযোগ্য পুনরুজ্জীবন ঘটাতে অনেক সময় লাগবে।
কারণ, শুল্ক হয়তো দ্রুত আরোপ করা যেতে পারে, কিন্তু রাতারাতি কারখানা তৈরি করা যায় না।
গাড়ি, সরঞ্জাম এবং কম্পিউটার চিপস তৈরির অত্যাধুনিক কারখানা তৈরি করতে বছর লেগে যেতে পারে এবং কয়েক বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগের প্রয়োজন হতে পারে।
এই ধরনের পুনরুজ্জীবনের জন্য মাসের পর মাস বা বছরের পর বছর নয়, বরং কয়েক দশক সময় লাগতে পারে।
এই বিষয়টি ট্রাম্পের ‘মেক আমেরিকা গ্রেট অ্যাগেইন’ কার্যক্রমের পথে একটি গুরুত্বপূর্ণ বাধা হয়ে দাঁড়ায়।
ব্যবসায়িক নেতারা জানতে চান, আগামী দিনগুলোতে শুল্কের হার কেমন থাকবে, শুধু তাই নয়, তারা ভবিষ্যতের কয়েক বছর বা এমনকি কয়েক দশক পরের পরিস্থিতিও জানতে চান।
অন্যথায়, তারা যুক্তরাষ্ট্রে কারখানা স্থানান্তরের জন্য বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ করতে দ্বিধা বোধ করতে পারেন, যেখানে শ্রম খরচ সাধারণত অনেক বেশি।
উদাহরণস্বরূপ, একটি অ্যালুমিনিয়াম উৎপাদন প্রকল্পের কথা ভাবুন, যার পরিকল্পনা ২০ থেকে ৪০ বছরের জন্য করা হয়।
স্বল্প সময়ের জন্য একটি শুল্ক কাঠামোর ওপর ভিত্তি করে যুক্তরাষ্ট্রে বিনিয়োগ করা সম্ভব নয়।
তাহলে, শুল্ক কত দিন স্থায়ী হবে?
বর্তমানে, ব্যবসায়িক নেতারা এক সপ্তাহের শেষে শুল্কের হার কেমন থাকবে, তা নিয়ে সন্দিহান থাকেন।
এমন পরিস্থিতিতে এক দশক বা তার বেশি সময়ের জন্য শুল্কের বিষয়ে নিশ্চিত হওয়া কঠিন।
ট্রাম্প যদি তার দ্বিতীয় মেয়াদেও উচ্চ শুল্ক বজায় রাখেন, তাহলে তার উত্তরসূরি ২০২৯ সালের জানুয়ারি থেকে সেই নীতি বজায় রাখবেন কিনা, তা বলা কঠিন।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, প্রেসিডেন্টরা প্রায়শই দীর্ঘমেয়াদী নীতি তৈরি করেন, কিন্তু তাদের উত্তরসূরিরা সেগুলোর ধারাবাহিকতা বজায় রাখবেন কিনা, তা নিশ্চিত থাকে না।
তাই এমন কিছু করা উচিত নয়, যা বাস্তবায়িত হতে দশ থেকে পনেরো বছর সময় নেয় এবং যা পরবর্তী সরকার বাতিল করে দিতে পারে।
বিশেষজ্ঞরা সতর্ক করে বলেন, শুল্ক নীতি অটো শিল্পের উত্তর আমেরিকার সরবরাহ শৃঙ্খলে পরিবর্তন আনতে পারে।
এর ফলে ভোক্তাদের জন্য উচ্চ মূল্যে নিম্নমানের গাড়ি পাওয়া যেতে পারে এবং এতে এক বা দুই দশক সময় লাগতে পারে।
হোয়াইট হাউজের পক্ষ থেকে স্বীকার করা হয়েছে, মার্কিন উৎপাদন ক্ষমতা বাড়ানো একটি “ধাপে ধাপে” প্রক্রিয়া।
প্রাথমিকভাবে, কম ব্যবহৃত বিদ্যমান সুবিধাগুলো বাড়ানো হচ্ছে, যার কারণ হলো সস্তা ইস্পাত ও অ্যালুমিনিয়ামের “অন্যায্য ডাম্পিং”।
ট্রাম্প ক্ষমতায় আসার পর, শিল্পখাতের নেতারা শুল্ক, নিয়ন্ত্রণমুক্তকরণ এবং আমেরিকান জ্বালানির উন্মোচনের মাধ্যমে “আমেরিকা ফার্স্ট” অর্থনৈতিক এজেন্ডার প্রতি সাড়া দিয়েছেন।
এর ফলে হাজার হাজার নতুন চাকরি তৈরি হবে এবং কয়েক ট্রিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ আসবে।
তবে, আন্তর্জাতিক অর্থনীতির প্রেক্ষাপটে যুক্তরাষ্ট্রের মতো একটি দেশে, যেখানে বিশ্বজুড়ে বাণিজ্য সম্পর্ক বিস্তৃত, সেখানে ট্রাম্পের পরিকল্পনা অনুযায়ী উৎপাদন খাতকে আগের অবস্থায় ফিরিয়ে আনা সহজ হবে না।
বিশ্লেষকদের মতে, উচ্চ শুল্ক সম্ভবত যুক্তরাষ্ট্রে কিছু নতুন বিনিয়োগকে উৎসাহিত করবে, তবে কৃষক এবং অন্যান্য রপ্তানিকারকরা তাদের গ্রাহকদের হারাতে পারেন, কর্মী ছাঁটাই হতে পারে এবং বাণিজ্য যুদ্ধে দেউলিয়া হওয়ার মতো ঘটনাও ঘটতে পারে।
কেউ কেউ মনে করেন, ট্রাম্পের বাণিজ্য কৌশল সময়সাপেক্ষ হলেও এটি একটি মূল্যবান প্রচেষ্টা।
তাদের মতে, বাণিজ্য এবং শিল্পনীতির ক্ষেত্রে দীর্ঘদিন ধরে ভুল পথে এগোনো হয়েছে এবং রাতারাতি এর পরিবর্তন সম্ভব নয়।
তবে, কত দিন পর্যন্ত আমেরিকানরা রাজনৈতিক বা অর্থনৈতিকভাবে এই বাণিজ্য যুদ্ধ সহ্য করতে পারবে, তা এখনও স্পষ্ট নয়।
বিনিয়োগকারীরা শুল্কের অবিরাম পরিবর্তন নিয়ে হতাশ।
এই অনিশ্চয়তা অর্থনৈতিক মন্দা বা এমনকি সংকট সৃষ্টি করতে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে।
ছোট ব্যবসার মালিকদের মধ্যে অর্থনৈতিক অনিশ্চয়তা বাড়ছে।
ভোক্তাদের আস্থা কমে যাওয়ায় অনেকেই উদ্বিগ্ন।
অর্থনীতিবিদরা মনে করছেন, মার্কিন অর্থনীতি সম্ভবত প্রথম ত্রৈমাসিকে সংকুচিত হবে।
যদিও মন্দা আসার ঝুঁকি বেড়েছে, তবে তারা আশা করছেন, শুল্ক তুলে নিলে অর্থনীতির ওপর চাপ কমতে পারে।
তবে, এর জন্য প্রস্তুতকারক এবং অন্যান্য শিল্পকে চাকরি স্থানান্তরের জন্য উৎসাহিত করতে শুল্ক যথেষ্ট দীর্ঘ সময় ধরে রাখা হবে কিনা, তা এখনো অনিশ্চিত।
বিশ্ব অর্থনীতির এই পরিবর্তনে বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশের জন্য সুযোগ ও চ্যালেঞ্জ উভয়ই রয়েছে।
বাংলাদেশের তৈরি পোশাক শিল্পসহ অন্যান্য রপ্তানিমুখী খাতগুলো বিশ্ব বাণিজ্য নীতির পরিবর্তনে ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে।
তাই, পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে টিকে থাকতে হলে কৌশলগত পদক্ষেপ নেওয়া জরুরি।
তথ্যসূত্র: সিএনএন