আন্টার্কটিকার বরফের নিচে লুকিয়ে থাকা নদীগুলো পৃথিবীর জলবায়ুর জন্য এক নতুন উদ্বেগের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। বিজ্ঞানীরা বলছেন, এই অঞ্চলের বরফ দ্রুত গলতে শুরু করলে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বেড়ে যাবে, যার সরাসরি প্রভাব পড়বে বাংলাদেশের উপকূলীয় অঞ্চলে।
বিশেষ করে, আমাদের দেশের দক্ষিণাঞ্চলের জেলাগুলো—যেখানে এরই মধ্যে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব দৃশ্যমান—নতুন করে আরও বড় ধরনের ক্ষতির শিকার হতে পারে।
গবেষকরা আন্টার্কটিকার বিশাল বরফের চাদরের নিচে এক জটিল নদী-জালের সন্ধান পেয়েছেন। কয়েক দশক ধরে, বিজ্ঞানীরা বিশেষ রাডার প্রযুক্তি ব্যবহার করে বরফের পুরু স্তর ভেদ করে এই নদীর ছবি তুলেছেন।
তাঁরা দেখেছেন, বরফের চাপ ও ভূ-তাপের কারণে এই নদীগুলো অদ্ভুতভাবে প্রবাহিত হয়, এমনকি পাহাড়ের দিকেও এদের জলধারা বয়ে যেতে পারে।
কানাডার ওয়াটারলু বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন হিমবাহ বিশেষজ্ঞ ক্রিস্টিন ডাউ এবং তাঁর দল এই গবেষণায় নেতৃত্ব দিয়েছেন। তাঁরা দেখেছেন, এই নদীগুলো হিমবাহের তলার বরফ গলিয়ে দেয়, যার ফলে হিমবাহগুলো দ্রুত সমুদ্রের দিকে এগিয়ে যায়।
ডাউয়ের মতে, “আমরা হয়তো আগামী ৮০ বছরে কতটা বরফ গলবে, তা এখনো পর্যন্ত কম হিসাব করছি।
এই গবেষণায় আরও দেখা গেছে, আন্টার্কটিকার উপকূলের কাছাকাছি থাকা বিশাল আকারের বরফের চাঁইগুলো, যা ‘আইস শেলফ’ নামে পরিচিত, সেগুলোর নিচে কিছু জায়গা অপ্রত্যাশিতভাবে দ্রুত গলছে।
উপগ্রহ থেকে পাওয়া তথ্যে দেখা যায়, সমুদ্রের স্বাভাবিক তাপমাত্রার চেয়েও বেশি হারে কিছু অঞ্চলে বরফ গলছে। বিজ্ঞানীরা বলছেন, এই গলনের কারণ হলো বরফের নিচ দিয়ে বয়ে যাওয়া নদীর জল।
এই জল যখন সমুদ্রের লবণাক্ত জলের সঙ্গে মিশে, তখন এক ধরনের ঘূর্ণাবর্ত তৈরি হয়। এই ঘূর্ণাবর্তের কারণে সমুদ্রের উষ্ণ জল উপরের দিকে উঠে আসে এবং বরফের চাঁইকে আরও দ্রুত গলিয়ে দেয়।
আন্টার্কটিকার সবচেয়ে অস্থির কিছু হিমবাহ, যেমন থোয়েটস ও পাইন আইল্যান্ড হিমবাহের নিচেও বিজ্ঞানীরা প্রচুর পরিমাণে জল দেখতে পেয়েছেন। এই হিমবাহগুলোর নিচে আগ্নেয়গিরি এবং ফাটল থাকায় ভূ-তাপের পরিমাণ বেশি, যার ফলে প্রচুর বরফ গলে জল তৈরি হয়।
এই জল হিমবাহগুলোকে পিছল করে দেয় এবং তারা দ্রুত সমুদ্রে গিয়ে পরে।
বিজ্ঞানীরা সতর্ক করে বলছেন, এই নদীগুলোর কারণে যদি বরফ গলতে থাকে, তাহলে ২০৩০ সালের মধ্যে টটেন হিমবাহ থেকে নির্গত জলের পরিমাণ পাঁচগুণ বেড়ে যেতে পারে।
এর অর্থ হলো, প্রতি সেকেন্ডে প্রায় ৫,৭০০ ঘনফুট জল সমুদ্রে মিশবে, যা আমাদের দেশের পদ্মা নদীর বর্তমান প্রবাহের প্রায় এক-চতুর্থাংশ। এর ফলে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা আরও বাড়বে এবং বাংলাদেশের উপকূলীয় অঞ্চলে ভাঙন ও প্লাবনের মতো প্রাকৃতিক দুর্যোগ আরও তীব্র হবে।
বিজ্ঞানীরা বলছেন, জলবায়ু পরিবর্তনের এই চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় আমাদের এখনই পদক্ষেপ নিতে হবে। আন্টার্কটিকার বরফ গলন প্রক্রিয়া ভালোভাবে বুঝতে পারলে, আমরা হয়তো সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধির পূর্বাভাস আরও ভালোভাবে দিতে পারব এবং সেই অনুযায়ী ব্যবস্থা নিতে পারব।
একইসঙ্গে, উন্নত দেশগুলোকে কার্বন নিঃসরণ কমাতে এবং জলবায়ু পরিবর্তনের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে আরও সক্রিয় হতে হবে, যাতে বাংলাদেশের মতো ঝুঁকিপূর্ণ দেশগুলোকে রক্ষা করা যায়।
তথ্য সূত্র: ন্যাশনাল জিওগ্রাফিক।