ইস্তাম্বুলে দারিদ্র্যের ছবি: আবর্জনা কুড়িয়ে জীবনযুদ্ধ
ইস্তাম্বুলের সংকীর্ণ গলিগুলোতে একদল মানুষের জীবন চলে, যারা শহরের আবর্জনা থেকে নিজেদের খাবারের সংস্থান করেন। তুরস্কের এই বৃহত্তম শহরে, বিত্তবানদের জীবনযাত্রার ভিড়ে দারিদ্র্যের এক গভীর চিত্র ফুটে উঠেছে।
সম্প্রতি দেশটির জীবনযাত্রার ব্যয় বেড়ে যাওয়ায় হাজার হাজার মানুষ, নারী এবং এমনকি শিশুরাও জীবিকা নির্বাহের বিকল্প পথ খুঁজছেন।
২৯ বছর বয়সী এরগিন দোগান, ইস্তাম্বুলের একটি বাণিজ্যিক এলাকার রাস্তায় পরিত্যক্ত কাগজ ও কার্টন সংগ্রহ করেন। তার মতে, এই কাজটি তিনি ছোটবেলা থেকেই করে আসছেন।
তার বাবাও একসময় তুরস্কের মধ্যাঞ্চলে নিগদে শহরে দারিদ্র্যের সঙ্গে লড়াই করেছেন। পরে তারা ভালো ভবিষ্যতের আশায় ইস্তাম্বুলে আসেন।
তবে এখানেও জীবন সহজ নয়। এরগিন জানান, তিনি ১৩ বছর বয়সে স্কুল ছেড়ে দিতে বাধ্য হয়েছিলেন। তাদের ঘুমানোর জায়গা সুলতান সুলেমান মসজিদের কাছাকাছি, যেখানে নোংরা কম্বল এবং ভালো কোনো স্নানের ব্যবস্থা নেই।
ভোর থেকে গভীর রাত পর্যন্ত তারা কাজ করেন। একদিন তার ভাঙা ভ্যানের চাকাটি সামান্য টেপ দিয়ে জোড়া লাগিয়ে আবার কাজে নামতে হয়েছিল।
সন্ধ্যায় এরগিনের বাবা একটি ট্রাকে করে আসেন এবং তাদের সংগৃহীত কাগজ ও প্লাস্টিক রিসাইক্লিং কেন্দ্রে নিয়ে যান। সেখান থেকে সেগুলো শিল্পে ব্যবহারের জন্য প্রস্তুত করা হয়।
গভীর রাতে কিছু লোক তাদের কাছ থেকে টাকা ছিনিয়ে নিতে আসে। এরগিনের ভাষ্যমতে, “যদি আমরা দিতে অস্বীকার করি, তবে তারা আমাদের হুমকি দেয়। আমরা দিনে ১২ ঘণ্টার বেশি, কখনো ১৭ ঘণ্টা পর্যন্ত কাজ করি। একদিন কাজ বন্ধ থাকলে আমাদের খাবার জোটে না।”
দোগানের ২১ বছর বয়সী চাচাতো ভাই এরগুন, ১৬ বছর বয়সী ছোট ভাই মেহমেত এবং তাদের বাবা ৪৮ বছর বয়সী সারদার দোগানও একই কাজ করেন।
এরগুনের কথায়, “যদি আমার ভ্যানের বস্তা কোনো পথচারীর গায়ে লাগে, তবে তারা বিরক্ত হয় এবং আমাকে তাদের কাছ থেকে দূরে থাকতে বলে।”
একটি পুনর্ব্যবহার কেন্দ্রের তত্ত্বাবধায়ক কুমালি বাকির মনে করেন, এই শ্রমিকদের সরকারি স্বীকৃতি দেওয়া উচিত। তাদের জন্য উপযুক্ত পোশাক এবং খাবারের ব্যবস্থা করা দরকার।
বাকির আরও বলেন, “তারা ১৫০ কিলোগ্রামের ওজনের ভ্যান ঠেলে পাহাড়ের মতো রাস্তা দিয়ে ওঠে, তাও প্রায়ই খালি পেটে।”
মেহমেত নামের এক কিশোর জানায়, অষ্টম শ্রেণি পাশ করার পর সে কাজে যোগ দিয়েছে। “কখনো কখনো আমি আমার বয়সী ছেলেমেয়েদের ঘোরাঘুরি করতে দেখি, তখন আমার খুব খারাপ লাগে।
আমি তাদের মতো পড়াশোনা করতে এবং বন্ধুদের সঙ্গে মজা করতে চাই,” – বলছিল মেহমেত।
সারদার দোগান ১৯৯৫ সাল থেকে কাগজ কুড়ানোর কাজ করছেন। তিনি বলেন, “আমার জীবনটা যেন একটা বোঝা। ভবিষ্যৎ পরিবর্তনের কোনো আশা দেখি না।”
প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইয়েপ এরদোগানের সরকারের আমলে ক্রমাগত মূল্যবৃদ্ধি, উচ্চ জ্বালানি খরচ এবং করোনাভাইরাস মহামারীর কারণে সৃষ্ট অর্থনৈতিক বিপর্যয় অনেক পরিবারকে খাদ্য ও বাসস্থান জোগাড় করতে হিমশিম খাচ্ছে।
সরকারি হিসাব অনুযায়ী, ফেব্রুয়ারি মাসের মুদ্রাস্ফীতি ছিল ৩৯.০৫ শতাংশ, তবে অনেক অর্থনীতিবিদ মনে করেন, প্রকৃত হার আরও বেশি। তুরস্কের জনসংখ্যার প্রায় ১৩.৬ শতাংশ মানুষ বর্তমানে দারিদ্র্যসীমার নিচে বাস করে।
এরকম কঠিন পরিস্থিতিতেও, ইস্তাম্বুলের এই উপেক্ষিত মানুষগুলো তাদের কাজ করে চলেছে।
এরগিনের কণ্ঠে শোনা যায়, “আমরাই ইস্তাম্বুলের আসল মালিক; এই রাস্তাগুলো আমাদের। যদি আগুন লাগে, তবে আমরাই সবার আগে ছুটে যাই সাহায্য করতে। আমরা শহরটাকে ভালোবাসি, কিন্তু শহরটা আমাদের ভালোবাসে না।”
তথ্য সূত্র: অ্যাসোসিয়েটেড প্রেস