ফর্মুলা ওয়ান (F1) বিশ্বের অন্যতম জনপ্রিয় মোটর রেসিং প্রতিযোগিতা। এই খেলার জগৎ একজন প্রভাবশালী ব্যক্তিত্বকে হারিয়েছে সম্প্রতি।
৭৬ বছর বয়সে প্রয়াত হয়েছেন বিখ্যাত রেসিং দল জর্ডান গ্রাঁ প্রিঁ-র প্রতিষ্ঠাতা, উদ্যোক্তা এবং মিডিয়া ব্যক্তিত্ব এডি জর্ডান।
এডি জর্ডান ছিলেন একজন ব্যতিক্রমী মানুষ, যিনি প্রচলিত ধারার বাইরে গিয়ে নিজের ভাগ্য গড়েছেন। তার দল গঠন, বিপণন কৌশল এবং তারকা খ্যাতি তাকে F1 এর ইতিহাসে এক বিশেষ স্থান দিয়েছে।
সম্প্রতি প্রোস্টেট ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে তিনি মারা যান।
১৯৯০-এর দশকে জর্ডান গ্রাঁ প্রিঁ দল গঠন করে তিনি F1 জগতে প্রবেশ করেন। তার দল প্রযুক্তি ও কর্পোরেট পৃষ্ঠপোষকতায় ভরপুর আধুনিক F1 দলের ভিড়ে কিছুটা ভিন্ন ছিল।
জর্ডান তার দলের জন্য আকর্ষণীয় বিপণন কৌশল নিতেন, যা দর্শক ও পৃষ্ঠপোষকদের নজর কাড়তে সহায়ক ছিল। দলের গাড়ির আকর্ষণ বাড়াতে প্রায়ই মডেলদের ব্যবহার করতেন তিনি।
জর্ডান শুধু একজন রেসিং দলের মালিক ছিলেন না, বরং তিনি ছিলেন একজন সফল ব্যবসায়ীও। তিনি তরুণ চালকদের প্রতিভা বিকাশে সহায়তা করেছেন এবং তাদের F1 জগতে পরিচিতি এনে দিয়েছেন।
মাইকেল শুমাখারের মতো কিংবদন্তি রেসারকে F1-এ সুযোগ করে দেওয়ার পেছনে তার অবদান অনস্বীকার্য। জর্ডানের হাত ধরেই ১৯৯১ সালে তার দল বিশ্ব চ্যাম্পিয়নশিপে পঞ্চম স্থান অর্জন করে, যা একটি নতুন দলের জন্য অসাধারণ ছিল।
১৯৯১ থেকে ২০০৫ সাল পর্যন্ত জর্ডান দলে বিভিন্ন সময়ের সেরা ড্রাইভাররা ছিলেন, যাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলেন এডি আরভাই, রুবেন্স বারিকুইলো, ড্যামন হিল, হাইঞ্জ-হারাল্ড ফ্রেনজেন এবং জ্যাঁ আলেসি।
১৯৯৮ সালে বেলজিয়ান গ্রাঁ প্রিঁতে হিলের জয় এবং ১৯৯৯ সালে ফ্রেনজেনের দুটি জয় জর্ডান দলকে বিশ্ব চ্যাম্পিয়নশিপে তৃতীয় স্থানে নিয়ে আসে। ২০০৩ সালে জিয়ানকার্লো ফিশিকেল্লা ব্রাজিলের ইন্টারlagos-এ দলের হয়ে শেষ জয়টি এনে দেন।
জর্ডানের খ্যাতি শুধু রেসিং ট্র্যাকের মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল না। তিনি ছিলেন খ্যাতিমান ব্যক্তিত্ব বার্নি এক্সক্লেস্টোনের ঘনিষ্ঠ বন্ধু এবং একজন সফল ডিলমেকার।
১৯৯৫ সালে আরভাইকে ফেরারি-তে বিক্রি করে তিনি বিপুল পরিমাণ অর্থ উপার্জন করেন। জর্ডান একবার বলেছিলেন, “আমি আরভাইকে বিনামূল্যে দলে নিয়ে এসে তিন বছরের চুক্তি দিই, এরপর তাকে তৈরি করি এবং ফেরারি-তে বিক্রি করি।
সে ১৩ থেকে ১৪ মিলিয়ন ডলার পেত, আর ফেরারি আমাকে দিত ৫ মিলিয়ন ডলার।” ১৯৯৬ সালে বেনসন অ্যান্ড হেজেস-এর সাথে স্পন্সরশিপ চুক্তির ফলে জর্ডানের গাড়ির রঙ হলুদ হয়।
জর্ডানের ব্যবসায়িক দূরদর্শিতার প্রমাণ পাওয়া যায় ১৯৯৮ সালে যখন তিনি প্রাইভেট ইক্যুইটি ফার্ম ওয়ারবার্গ পিনকাস-এর কাছে তার শেয়ারের অর্ধেক বিক্রি করেন এবং পরে তা উল্লেখযোগ্য মুনাফায় কিনে নেন।
পরে তিনি বিলিয়নেয়ার অ্যালেক্স স্নেইডারের কাছে প্রায় ৬ কোটি ডলারে জর্ডান গ্রাঁ প্রিঁ বিক্রি করেন। এই দল পরবর্তীতে মিডল্যান্ড F1, স্পাইকার এবং ফোর্স ইন্ডিয়া নামে পরিচিত হয় এবং বর্তমানে অ্যাস্টন মার্টিন হিসেবে F1-এ প্রতিযোগিতা করছে।
২০২৪ সালে তিনি আবারও তার দক্ষতার প্রমাণ দেন, যখন তিনি সম্ভবত F1 ইতিহাসের সেরা কার ডিজাইনার অ্যাড্রিয়ান নিউইকে রেড বুল থেকে অ্যাস্টন মার্টিনে নিয়ে আসার জন্য ম্যানেজারের ভূমিকা পালন করেন।
শোনা যায়, নিউইকে অ্যাস্টন মার্টিনে আনতে তিনি প্রায় ৩ কোটি পাউন্ড বেতন চুক্তি করেন।
দল বিক্রির পর জর্ডান মিডিয়া জগতে প্রবেশ করেন এবং ধারাভাষ্যকার হিসেবে পরিচিতি লাভ করেন। ২০০৯ সাল থেকে তিনি বিবিসি স্পোর্ট-এর গ্রাঁ প্রিঁ প্রোগ্রামে এবং ২০১৬ সাল থেকে চ্যানেল ৪-এর F1 কভারেজে কাজ করেন।
২০১৬ থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত তিনি টপ গিয়ার অনুষ্ঠানে উপস্থাপনা করেছেন। ২০২৩ সালে তিনি এবং ডেভিড কুলহার্ড ‘ফর্মুলা ফর সাকসেস’ নামে একটি পডকাস্ট শুরু করেন।
আয়ারল্যান্ডের ডাবলিনে জন্ম নেওয়া এডি জর্ডান ছিলেন প্যাডি এবং আইলিন জর্ডানের ছেলে। তার বাবা ছিলেন ইলেকট্রিসিটি সাপ্লাই বোর্ডের হিসাবরক্ষক এবং মা ছিলেন গৃহিণী।
শৈশবে তিনি স্কুলের পাঠ্যবই, মার্বেল ও কড়ি বিক্রির ব্যবসা করতেন। তিনি একসময় যাজক হওয়ারও স্বপ্ন দেখেছিলেন।
১৯৭০ সালে ব্যাংকিং ধর্মঘটের কারণে তিনি হিসাববিজ্ঞানে প্রশিক্ষণের জন্য জার্সি চলে যান, যেখানে তিনি কার্টিংয়ের প্রতি আকৃষ্ট হন। ১৯৭১ সালে তিনি আইরিশ কার্ট চ্যাম্পিয়নশিপ জেতেন।
১৯৭৮ সালে তিনি আইরিশ ফর্মুলা আটলান্টিক খেতাব জেতেন। পরবর্তীতে তিনি ইংল্যান্ডে পাড়ি জমান এবং ফর্মুলা থ্রিতে (Formula Three) নিজের ভাগ্য চেষ্টা করেন।
মোটর রেসিং ছাড়াও জর্ডানের অন্যান্য ব্যবসা ছিল। তার উল্লেখযোগ্য পরিমাণ সম্পত্তি ছিল এবং তিনি সেল্টিক এফসি এবং লন্ডন আইরিশ রাগবি ক্লাবের শেয়ারহোল্ডার ছিলেন।
গেমিং ও বিনোদন ব্যবসায়েও তিনি বিনিয়োগ করেছিলেন। তিনি নিজের নামে একটি ভদকা ও একটি এনার্জি ড্রিঙ্কও বাজারে এনেছিলেন।
এডি জর্ডান বিভিন্ন সমাজসেবামূলক কাজের সঙ্গেও জড়িত ছিলেন। তিনি শিশুদের ক্যান্সার হাসপাতাল CLIC সার্জেন্ট এবং তরুণদের সাহায্যকারী সংস্থা অ্যাম্বার ফাউন্ডেশনের পৃষ্ঠপোষক ছিলেন।
২০১২ সালে সমাজসেবা ও মোটর রেসিংয়ে অবদানের জন্য তাকে অনারারি ওবিই (OBE) উপাধিতে ভূষিত করা হয়। ২০০৭ সালে তার আত্মজীবনী ‘অ্যান ইন্ডিপেন্ডেন্ট ম্যান’ প্রকাশিত হয়।
এডি জর্ডানের প্রয়াণে বার্নি এক্সক্লেস্টোন বলেন, “এডি ছিলেন অসাধারণ একজন মানুষ। আজকের দিনে তার মতো টিম প্রিন্সিপাল খুঁজে পাওয়া কঠিন। F1-এ তার শূন্যতা পূরণ হওয়ার নয়।”
এডি জর্ডান তার স্ত্রী মারি এবং সন্তান জো, মিকি, যাক ও কাইলের জন্য শোক রেখে গেছেন।
তথ্য সূত্র: দ্য গার্ডিয়ান