শিরোনাম: জর্জ ফোরম্যান: ১৯৬৮ সালের অলিম্পিকে একটি পতাকা ওড়ানো, বর্ণবাদ ও পরিচয়ের এক জটিল আখ্যান।
১৯৬৮ সালের মেক্সিকো সিটি অলিম্পিকে বক্সিংয়ে স্বর্ণপদক জয়ী টেক্সাসের এক তরুণ, জর্জ ফোরম্যান, যখন আমেরিকার পতাকা হাতে বিজয় উদযাপন করছিলেন, সম্ভবত তিনি ঘুণাক্ষরেও টের পাননি যে তাঁর এই আনন্দ উদযাপন কতটা রাজনৈতিক বিতর্কের জন্ম দেবে।
সেই সময় আমেরিকায় নাগরিক অধিকারের দাবিতে আন্দোলন তুঙ্গে, কৃষ্ণাঙ্গ মানুষের প্রতি বৈষম্য নিয়ে প্রতিবাদ চলছে। ফোরম্যানের এই পতাকা ওড়ানো, সেই অস্থির সময়ে, অনেকের কাছেই ছিল অপ্রত্যাশিত।
তাঁর এই পদক্ষেপকে অনেকে চিহ্নিত করেছিলেন প্রতিবাদের কণ্ঠরোধ হিসেবে।
ফোরম্যানের এই উদযাপন, অনেকের কাছেই, বিশেষ করে কৃষ্ণাঙ্গ সম্প্রদায়ের মধ্যে, গভীর ক্ষোভের জন্ম দেয়। তাঁরা প্রশ্ন তোলেন, যে দেশ তাঁদের অধিকার থেকে বঞ্চিত করছে, সেই দেশের প্রতি কীভাবে একজন কৃষ্ণাঙ্গ মানুষ এত আবেগ দেখাতে পারেন?
সেই সময়ে টমি স্মিথ ও জন কার্লোস নামের দুই কৃষ্ণাঙ্গ আমেরিকান অ্যাথলেট তাঁদের প্রতিবাদের অংশ হিসেবে পুরস্কার বিতরণী মঞ্চে মাথা নিচু করে এবং কালো গ্লাভস পরিহিত অবস্থায় তাঁদের হাত উপরে তুলে ধরেন।
তাঁদের এই নীরব প্রতিবাদ ছিল বর্ণবাদের বিরুদ্ধে এক শক্তিশালী বার্তা।
ফোরম্যানের পতাকা ওড়ানোর ঘটনার বিপরীতে, তাঁদের এই প্রতিবাদ একবিংশ শতাব্দীর অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ প্রতিচ্ছবি হিসেবে আজও স্মরণীয়।
তবে, ফোরম্যানের গল্প এত সরল নয়।
হিউস্টনের একটি দরিদ্র, কৃষ্ণাঙ্গ অধ্যুষিত এলাকা থেকে উঠে আসা ফোরম্যান, দারিদ্র্য থেকে মুক্তি খুঁজে পান বক্সিংয়ের মাধ্যমে। তিনি একটি ফেডারেল সরকারের দারিদ্র্য বিমোচন কর্মসূচির অধীনে প্রশিক্ষণ নেন।
তাঁর চোখে, আমেরিকার পতাকা ছিল সেই দেশের প্রতীক, যা তাঁকে ঘুরে দাঁড়ানোর সুযোগ দিয়েছিল। তাঁর দেশপ্রেম ছিল গভীর ব্যক্তিগত, যা হয়তো অনেকের কাছে ছিল অনুধাবনযোগ্য নয়।
সমালোচকেরা ফোরম্যানকে “আংকেল টম” হিসেবে চিহ্নিত করেন। শ্বেতাঙ্গ সমাজের কাছে সমর্থন আদায়ের জন্য তিনি এমনটা করেছেন বলেও অভিযোগ ওঠে।
অনেকে তাঁকে কৃষ্ণাঙ্গ সম্প্রদায়ের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতক হিসেবেও দেখেন। এসব সমালোচনার জবাবে ফোরম্যান নিজেকে গুটিয়ে নেন।
বক্সিং রিংয়ে তিনি আরও আগ্রাসী হয়ে ওঠেন, তবে, তাঁর ভেতরের নীরব ক্রোধ সবসময় বিদ্যমান ছিল।
পরবর্তীকালে, ফোরম্যানের জীবনে আসে পরিবর্তন। ১৯৭৪ সালে মোহাম্মদ আলীর কাছে পরাজয়ের পর তিনি প্রায় এক দশক বক্সিং থেকে দূরে ছিলেন।
এই সময়ে তিনি ধর্ম গ্রহণ করেন এবং একটি যুব কেন্দ্র খোলেন। এরপর যখন তিনি আবার ফিরে আসেন, তখন তাঁর মধ্যে দেখা যায় এক ভিন্ন মানুষ।
তাঁর শরীর ভারী হয়েছে, খেলাধুলার ধরনেও এসেছে পরিবর্তন। তাঁর মধ্যে এখন দেখা যায় এক ধরনের ভদ্রতা।
১৯৯০-এর দশকে, ফোরম্যান যখন আবার বক্সিংয়ে ফিরে আসেন, তখন তাঁর প্রতি মানুষের মনোভাব ছিল অনেক বেশি ইতিবাচক। তিনি হাসতেন, কৌতুক করতেন এবং টেলিভিশন অনুষ্ঠানে নিয়মিত অংশ নিতেন।
এমনকি ৪৫ বছর বয়সে তিনি যখন আবার হেভিওয়েট খেতাব জেতেন, তখন তা ছিল এক নতুন উত্থান।
ফোরম্যানের এই জীবন, আমাদের শিক্ষা দেয় যে কৃষ্ণাঙ্গ মানুষের দেশপ্রেম সবসময় একরকম হয় না।
কেউ হয়তো প্রতিবাদের মাধ্যমে তাঁদের অধিকারের কথা বলেন, আবার কেউ হয়তো তাঁদের কঠিন পরিশ্রমের মাধ্যমে নিজেদের প্রমাণ করেন।
১৯৬৮ সালের সেই ঘটনার মূল শিক্ষা হলো, কৃষ্ণাঙ্গ অ্যাথলেটদের উপর একটি সম্মিলিত অভিজ্ঞতার প্রতীক হওয়ার যে কঠিন বোঝা চাপানো হয়, তা প্রায়শই অসহনীয়।
আজও, ফোরম্যানের গল্প আমাদের মনে করিয়ে দেয়, একটি রাষ্ট্রে, যেখানে অনেক সময় কৃষ্ণাঙ্গ মানুষদের হয় ক্রোধ অথবা কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করতে হয়, সেখানে জর্জ ফোরম্যান ভিন্ন পথে হেঁটেছিলেন।
তিনি শুধু আমেরিকার সম্ভাবনাকে তুলে ধরেছিলেন, যা হয়তো অনেকের কাছে ছিল অনুপ্রেরণাদায়ক।
তথ্য সূত্র: The Guardian