ব্রিটিশ আশ্রয়ের প্রত্যাশী নারী ও কিশোরীরা যৌন নির্যাতনের শিকার—এমন গুরুতর অভিযোগ উঠেছে। যুক্তরাজ্যে আশ্রয় চেয়ে আসা নারীদের অভিযোগ, তাদের রাখা হয়েছে এমন সব সরকারি আবাসন কেন্দ্রে, যেখানে যৌন নিগ্রহ, ধর্ষণ ও হেনস্থার মতো ঘটনা ঘটেছে।
একটি অনুসন্ধানে জানা গেছে, একাধিক আশ্রয়কেন্দ্রে যৌন সহিংসতার অভিযোগ উঠেছে, যেখানে আশ্রয়প্রার্থীদের পাশাপাশি কর্মী ও হোটেল কর্মচারীদের বিরুদ্ধেও অভিযোগ রয়েছে।
একটি ঘটনায়, দক্ষিণ-পশ্চিম ইংল্যান্ডের একটি হোটেলে, যেখানে বেশিরভাগ পুরুষ ছিলেন, সেখানে ১৪ বছর বয়সী এক কিশোরীকে তার মায়ের থেকে আলাদা করে রাখা হয়েছিল। অভিযোগ, এরপর তাকে ফুসলিয়ে ধর্ষণ করা হয়।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ওই কিশোরীর মা জানান, তার মেয়ে আগে নির্যাতনের শিকার হয়েছিল এবং সে খুবই অসহায় অবস্থায় ছিল। তিনি বলেন, “মেয়ে ও তার ভাইকে আমার থেকে আলাদা করে অন্য একটি কক্ষে রাখা হয়েছিল, যা পুরুষদের একটি দলের পাশের ঘর ছিল।
আমি কর্মীদের কাছে বারবার আমার উদ্বেগের কথা জানালেও তারা শোনেনি। এমনকি রাতে তাদের উপর নজর রাখার জন্য যখন আমি দরজা খোলা রাখতে চাইলাম, তখন কর্মীরা সেটিও বন্ধ করতে বলেন।”
ভুক্তভোগী কিশোরীকে পাশের কক্ষের এক ব্যক্তি খাবার দিত এবং নিজের ঘরে ডাকত। ঘটনার কয়েক মাস পর, ২০২৩ সালের অক্টোবরে, যখন কিশোরীর স্ত্রীরোগ সংক্রান্ত সমস্যা দেখা দেয়, তখনই ধর্ষণের বিষয়টি প্রকাশ হয়।
মায়ের অভিযোগ, সরকারের গাফিলতির কারণে ওই ব্যক্তি তার মেয়ের উপর নির্যাতন চালানোর সুযোগ পেয়েছিল। “আবাসন কেন্দ্রটির নিরাপত্তা ব্যবস্থা ছিল খুবই দুর্বল। সেখানে প্রায়ই মারামারি, চিৎকার, এমনকি মাদক সেবনের মতো ঘটনা ঘটত।
আমি খুবই অস্বস্তিতে ছিলাম, কারণ আমার সন্তানরা আমার সঙ্গে ছিল না।” তিনি আরও জানান, ঘটনার পর তার মেয়ে আত্মহত্যার চেষ্টা করেছিল এবং স্কুলে যেতে রাজি ছিল না।
পরবর্তীতে হোটেলটি বন্ধ করে দেওয়া হয়। ব্রিটিশ স্বরাষ্ট্র দপ্তর (Home Office) জানিয়েছে, তারা এই ঘটনায় ‘অত্যন্ত উদ্বিগ্ন’ এবং বিষয়টি খতিয়ে দেখছে।
কিশোরীর মা জানান, সম্ভবত স্বরাষ্ট্র দপ্তর বুঝতে পেরেছিল তারা ভুল করেছে, কারণ হোটেলটি বন্ধ করার পর তাদের একটি নারী-সুরক্ষিত হোটেলে স্থানান্তর করা হয়। “প্রকৃতপক্ষে, শুরুতেই তাদের এমনটা করা উচিত ছিল, কিন্তু তারা সম্ভবত খরচ কমাতে চেয়েছিল।”
আরেকটি ঘটনায়, ‘রেপ ক্রাইসিস’ নামক একটি সংস্থার সহায়তায় এক গর্ভবতী নারীকে একটি মিশ্র-আবাসনে রাখা হয়েছিল। সন্তান জন্ম দেওয়ার পরও তিনি সেখানেই ছিলেন।
তিনি জানান, তার পাশের কক্ষে থাকা পুরুষরা একসঙ্গে মদ্যপান করত এবং মাদক সেবন করত। এছাড়া, তিনি প্রায়ই তাদের দ্বারা অনুসরণ হতেন।
এছাড়াও, যৌন নির্যাতনের শিকার হওয়া আরও একজন নারীকে মিশ্র-আবাসনে রাখা হয়েছিল, এমনকি যৌন শোষণের শিকার হওয়ার কথা জানানোর পরও। সিয়েরা লিওন থেকে আসা ওই নারী যুক্তরাজ্যে আসার পর, আগে বিশ্বাস করা একজনের দ্বারা আবারও নির্যাতনের শিকার হন।
তাকে একটি ‘নিরাপদ আশ্রয়ে’ নেওয়া হয়, যেখানে তিনি আশ্রয় আবেদনের প্রক্রিয়াকরণের জন্য অপেক্ষা করছিলেন। কিন্তু বাস্তবে, সেটি ছিল পুরুষ ও নারীদের জন্য একটি হোস্টেল, যেখানে মাদক সেবনকারীরাও ছিল।
তিনি জানান, সেই সাত মাস ছিল তার জীবনের সবচেয়ে ভীতিকর সময়।
ভুক্তভোগীদের অভিযোগের ভিত্তিতে জরুরি পদক্ষেপ নেওয়ার জন্য স্বরাষ্ট্র দপ্তরের প্রতি আহ্বান জানানো হয়েছে। ‘রেপ ক্রাইসিস’-এর প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা সিয়ারা বার্গম্যান এই ঘটনাগুলোকে ‘কেলেঙ্কারি’ হিসেবে বর্ণনা করেছেন।
মানবাধিকার বিষয়ক আইনজীবী সারা কলিয়ার জানান, আশ্রয়কেন্দ্রে নারীদের নিরাপত্তা বিষয়ক অনেক সমস্যা দেখা যাচ্ছে। এমনকি, অতীতে যৌন নির্যাতনের শিকার হওয়া নারীদেরও মিশ্র-আবাসনে রাখা হচ্ছে।
যেসব ব্যক্তির বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠেছে, তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার ক্ষেত্রে কর্তৃপক্ষের উদাসীনতা নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে। বিশেষ করে, যেখানে কোনো বাসিন্দার বিরুদ্ধে অভিযোগ আসে, সেখানে কর্তৃপক্ষের তেমন কোনো পদক্ষেপ দেখা যায় না।
মহিলা ও উদ্বাস্তু নারী বিষয়ক কর্মীদের মতে, আশ্রয়কেন্দ্রে নারীদের নিরাপত্তা একটি বড় উদ্বেগের বিষয়। তাদের মতে, নারীদের অন্যদের সঙ্গে, এমনকি অপরিচিত পুরুষদের সঙ্গেও বাথরুমের মতো স্থান ভাগাভাগি করতে বাধ্য করা হচ্ছে।
এছাড়া, যারা নিজ দেশে যৌন নির্যাতনের শিকার হয়েছেন, তাদের মিশ্র-আবাসনে রাখা হচ্ছে, যেখানে তারা আবারও যৌন সহিংসতার শিকার হচ্ছেন।
এই ঘটনার সম্পূর্ণ চিত্র এখনো পরিষ্কার নয়, কারণ স্বরাষ্ট্র দপ্তর তথ্য অধিকার আইনের অধীনে তথ্য সরবরাহ করতে ব্যর্থ হয়েছে। তারা আশ্রয়কেন্দ্রে যৌন সহিংসতার অভিযোগের সংখ্যা জানাতে অস্বীকৃতি জানিয়েছে।
এছাড়া, কতজন কর্মীর বিরুদ্ধে যৌন অসদাচরণের অভিযোগ এসেছে এবং কতজনকে বরখাস্ত করা হয়েছে, সেই সংক্রান্ত তথ্য দিতেও তারা রাজি হয়নি।
দাতব্য সংস্থাগুলোর গবেষণা থেকে জানা যায়, এই সমস্যা ব্যাপক। ‘উইমেন ফর রিফিউজি উইমেন’ -এর সাম্প্রতিক এক জরিপে দেখা গেছে, প্রায় এক চতুর্থাংশ নারী আশ্রয়প্রার্থীদের দ্বারা যৌন হয়রানি বা নির্যাতনের শিকার হয়েছেন, যেখানে ১২ শতাংশ কর্মী দ্বারা নিগৃহীত হয়েছেন।
জরিপে অংশ নেওয়া ৫৯ জন নারীর মধ্যে ৮১ শতাংশ মিশ্র-আবাসনে ছিলেন। তাদের মধ্যে দুই-তৃতীয়াংশ নারী জানিয়েছেন, তারা নারী-সুরক্ষিত আবাসন অথবা নারী-পুরুষের জন্য আলাদা স্থান রয়েছে এমন আবাসন পছন্দ করতেন।
স্বরাষ্ট্র দপ্তর জানিয়েছে, আশ্রয়কেন্দ্রে নারী ও শিশুদের স্বাস্থ্য ও নিরাপত্তা রক্ষা করা তাদের প্রধান দায়িত্ব। তারা এই ধরনের ঘটনাগুলোর তদন্ত করবে এবং ভবিষ্যতে আশ্রয় ব্যবস্থাপনায় পরিবর্তন আনার চেষ্টা করবে।
তথ্য সূত্র: দ্য গার্ডিয়ান