ইসরায়েলে রাজনৈতিক অস্থিরতা, নেতানিয়াহুর পদক্ষেপের বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিক্রিয়া।
তেল আবিব, ইসরায়েল – ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু দেশের শীর্ষস্থানীয় কিছু কর্মকর্তাকে অপসারণের সিদ্ধান্ত নেওয়ায় রাজনৈতিক সংকট আরও ঘনীভূত হচ্ছে। নেতানিয়াহুর এই পদক্ষেপে ইসরায়েলের অভ্যন্তরে বিভেদ আরও বাড়ছে এবং দেশটিতে দেখা দিয়েছে অস্থিরতা।
গত কয়েকদিনে সরকার বিরোধী বিক্ষোভে হাজার হাজার মানুষ অংশ নিয়েছে। দেশটির সাবেক প্রধান বিচারপতি গৃহযুদ্ধের আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, শীর্ষস্থানীয় আইনি ও নিরাপত্তা কর্মকর্তাদের বরখাস্ত করার পরিকল্পনা বাস্তবায়িত হলে সাংবিধানিক সংকট দেখা দিতে পারে।
গত সপ্তাহে প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহু অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা সংস্থা শিন বেটের প্রধান রোনেন বারকে বরখাস্ত করেন। হামাসের ৭ অক্টোবরের হামলার প্রতিরোধে ব্যর্থতার কারণে তার প্রতি আস্থা সংকট তৈরি হয়েছে বলে নেতানিয়াহু উল্লেখ করেছেন। একইসঙ্গে, অ্যাটর্নি জেনারেলকে তার পদ থেকে অপসারণের প্রক্রিয়াও শুরু করেছে সরকার। তাদের অভিযোগ, অ্যাটর্নি জেনারেল সরকারের এজেন্ডা বাস্তবায়নে বাধা দিচ্ছেন।
শিন বেট বর্তমানে নেতানিয়াহুর অফিসের সম্ভাব্য অনুপ্রবেশের বিষয়ে তদন্ত করছে। এছাড়াও, নেতানিয়াহুর বিরুদ্ধে দুর্নীতির মামলা চলছে। এই পরিস্থিতিতে নেতানিয়াহুর এই পদক্ষেপগুলো বিচার বিভাগের সঙ্গে তার বিরোধ তৈরি করছে।
২০২৩ সালের গোড়ার দিকে নেতানিয়াহুর সরকার বিচার বিভাগে ব্যাপক সংস্কারের উদ্যোগ নেয়, যা ব্যাপক প্রতিবাদের জন্ম দেয়। সমালোচকরা বলছেন, এই সংস্কারের ফলে নেতানিয়াহুকে অতিরিক্ত ক্ষমতা দেওয়া হবে এবং দেশের ভারসাম্য নষ্ট হবে। তাদের মতে, শক্তিশালী ও স্বাধীন বিচার বিভাগ কর্তৃত্ববাদী শাসনের বিরুদ্ধে জরুরি সুরক্ষা ব্যবস্থা।
তবে হামাসের ৭ অক্টোবরের হামলার পর গাজায় যুদ্ধ শুরু হওয়ায় সংস্কারের প্রক্রিয়া স্থগিত করা হয়। কিন্তু এর জেরে ইসরায়েলের ইতিহাসে সবচেয়ে ভয়াবহ দিনটির জন্য কে দায়ী, তা নিয়ে নতুন করে বিভাজন তৈরি হয়েছে। নেতানিয়াহু সরাসরি দায় স্বীকার না করে সামরিক বাহিনী এবং শিন বেটের প্রধানদের দিকে ইঙ্গিত করেছেন।
রোনেন বারকে বরখাস্ত করার ঘোষণার পর ব্যাপক বিক্ষোভ শুরু হয়। বিক্ষোভকারীরা বলছেন, এই পদক্ষেপ ইসরায়েলের স্বাধীন প্রতিষ্ঠানগুলোকে দুর্বল করবে এবং নেতানিয়াহুর অফিসের তদন্তকে প্রভাবিত করার চেষ্টা করা হচ্ছে।
এদিকে, অতি-ডানপন্থী রাজনীতিবিদ ইতামার বেন-গভিরকে মন্ত্রিসভায় ফিরিয়ে আনা হয়েছে। বিশ্লেষকরা বলছেন, এর মাধ্যমে বাজেট ভোটের আগে নেতানিয়াহুর ক্ষমতা আরও সুসংহত হবে।
রোনেন বার নিজেও জানিয়েছেন, তিনি সময়মতো পদত্যাগ করার পরিকল্পনা করেছিলেন। তিনি কাতার-সংক্রান্ত সংবেদনশীল তদন্ত শেষ করতে চেয়েছিলেন। অভিযোগ রয়েছে, কাতার হামাসের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রেখে নেতানিয়াহুর উপদেষ্টাদের মাধ্যমে ইসরায়েলে প্রভাব বিস্তারের চেষ্টা করছে। তবে নেতানিয়াহু ইঙ্গিত দিয়েছেন, এই তদন্ত অ্যাটর্নি জেনারেলের সঙ্গে বার-এর যোগসাজশের ফল।
সরকার ইতিমধ্যে অ্যাটর্নি জেনারেল গালি বাহারাভ-মিয়ারকে অপসারণের সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এখন একটি কমিটি গঠন করা হবে, যেখানে নেতানিয়াহুর মিত্রদের প্রাধান্য থাকবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। এই কমিটি অ্যাটর্নি জেনারেল এবং সরকারের বক্তব্য শুনবে এবং তাদের সুপারিশ পেশ করবে। এরপর নেতানিয়াহু সরকার চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেবে।
যদি কমিটি তাকে অপসারণের পক্ষে মত দেয়, তবে সুপ্রিম কোর্টে এর বিরুদ্ধে চ্যালেঞ্জ জানানো হতে পারে। কারণ, অ্যাটর্নি জেনারেলকে বরখাস্ত করার ক্ষেত্রে নেতানিয়াহুর স্বার্থের সংঘাত রয়েছে কিনা, সে বিষয়ে আদালত সিদ্ধান্ত নিতে পারে। কারণ তিনিই দুর্নীতির অভিযোগে অভিযুক্ত।
ইসরায়েলের গণতন্ত্র ইনস্টিটিউটের সিনিয়র গবেষক আমির ফুচস বলেন, সরকার যদি আদালতের রায় গ্রহণ না করে, তবে এটি একটি বিপজ্জনক পরিস্থিতি তৈরি করবে। এর ফলে আদালতের সিদ্ধান্ত, নাকি সরকারের সিদ্ধান্ত – কোনটি অনুসরণ করা হবে, তা নিয়ে সংকট দেখা দেবে এবং বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হতে পারে।
এই পরিস্থিতি নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করে ইসরায়েলের প্রখ্যাত আইনজ্ঞ ৮৮ বছর বয়সী আহারন বারাক সম্ভাব্য গৃহযুদ্ধের আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন। তিনিসহ সুপ্রিম কোর্টের প্রায় ২০ জন সাবেক বিচারপতি অ্যাটর্নি জেনারেলকে বরখাস্ত করার সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে এক যুক্ত বিবৃতিতে স্বাক্ষর করেছেন। বিরোধীদলীয় নেতা ইয়াইর লাপিদ সরকারের সিদ্ধান্তের বিরোধিতা করে কর বিদ্রোহের ডাক দিয়েছেন।
২০২৩ সালেও যখন বিচার বিভাগীয় সংস্কারের ঘোষণা করা হয়েছিল, তখন এমন সতর্কবার্তা শোনা গিয়েছিল। ব্যাপক বিক্ষোভ, ধর্মঘট এবং রিজার্ভ সেনাদের সামরিক দায়িত্ব পালন না করার হুমকি দেওয়া হয়েছিল।
তথ্য সূত্র: অ্যাসোসিয়েটেড প্রেস