মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের গবেষকদের জন্য ‘বৈজ্ঞানিক আশ্রয়স্থল’ খুলছে ইউরোপীয় বিশ্ববিদ্যালয়।
বিজ্ঞানচর্চার স্বাধীনতাকে সুনিশ্চিত করতে এবং ডোনাল্ড ট্রাম্পের সরকারের নীতিমালার কারণে ক্ষতিগ্রস্ত হওয়া মার্কিন গবেষকদের পাশে দাঁড়াতে এগিয়ে এসেছে ইউরোপের বেশ কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয়। ট্রাম্প প্রশাসনের সময়ে গবেষণা খাতে অর্থ বরাদ্দ হ্রাস এবং রাজনৈতিক হস্তক্ষেপের কারণে সেখানকার বিজ্ঞানীরা যখন কঠিন পরিস্থিতির শিকার, তখন ইউরোপের এই বিশ্ববিদ্যালয়গুলো তাদের জন্য খুলে দিয়েছে বিশেষ সুযোগ।
খবরটি জানিয়েছে প্রভাবশালী ব্রিটিশ গণমাধ্যম ‘দ্য গার্ডিয়ান’।
বেলজিয়ামের রাজধানী ব্রাসেলসে অবস্থিত ভ্রিজে ইউনিভার্সিটি ব্রাসেল (VUB) কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, তারা আন্তর্জাতিক গবেষকদের জন্য ১২টি পোস্টডক্টরাল পদের ঘোষণা করেছে। বিশেষভাবে মার্কিন গবেষকদের জন্য এই সুযোগ তৈরি করা হয়েছে।
বিশ্ববিদ্যালয়টির রেক্টর, জান ড্যানকায়োর্ট এক বিবৃতিতে জানান, ‘আমরা মনে করি, এটা আমাদের দায়িত্ব যে আমরা আমাদের আমেরিকান সহকর্মীদের পাশে দাঁড়াই।’ তিনি আরও বলেন, ‘মার্কিন বিশ্ববিদ্যালয় এবং সেখানকার গবেষকরা রাজনৈতিক ও আদর্শগত হস্তক্ষেপের কারণে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন।
তারা তাদের গবেষণা তহবিলের লক্ষ লক্ষ ডলার হারাচ্ছেন, যার কারণ হলো রাজনৈতিক ভিন্নমত।’
শুধু VUB নয়, ফ্রান্সের প্যারিসে অবস্থিত খ্যাতনামা পাস্তুর ইনস্টিটিউটও (Pasteur Institute) মার্কিন গবেষকদের আকৃষ্ট করার জন্য কাজ শুরু করেছে।
জানা গেছে, সংক্রামক রোগ বা রোগের উৎপত্তির মতো বিষয়গুলোতে গবেষণার জন্য তারা ইতিমধ্যে আটলান্টিক পারের বিজ্ঞানীদের সঙ্গে যোগাযোগ করছে।
পাস্তুর ইনস্টিটিউটের পরিচালক ইয়াসমিন বেলকায়েড ফরাসি সংবাদপত্র ‘লা ট্রিবিউন’-কে বলেছেন, ‘আমি প্রতিদিন এমন অনেক অনুরোধ পাচ্ছি, যেখানে গবেষণা চালিয়ে যেতে ইচ্ছুক, এমন ফরাসি, ইউরোপীয় এবং আমেরিকান বিজ্ঞানী রয়েছেন, যারা হয় তাদের গবেষণা চালিয়ে যেতে পারছেন না, অথবা স্বাধীনভাবে গবেষণা করতে ভয় পাচ্ছেন।
এটাকে হয়তো দুঃখজনক সুযোগ বলা যেতে পারে, তবে এটি একটি সুযোগ।’
ফ্রান্সের উচ্চশিক্ষা ও গবেষণা মন্ত্রী ফিলিপ বাপতিস্তও একই সুর মেলালেন।
তিনি গবেষণা প্রতিষ্ঠানগুলোকে মার্কিন বিজ্ঞানী আকর্ষণে প্রস্তাব জমা দেওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন।
বাপতিস্ত বলেন, ‘ইতিমধ্যে অনেক খ্যাতিমান গবেষক যুক্তরাষ্ট্রে তাদের ভবিষ্যৎ নিয়ে প্রশ্ন তুলছেন।
আমরা তাদের স্বাগত জানাতে চাই।’
নেদারল্যান্ডসও (Netherlands) ঘোষণা করেছে, তারা দ্রুত একটি তহবিল চালু করতে যাচ্ছে, যা বিজ্ঞানীদের আকৃষ্ট করবে।
এই তহবিল সব দেশের মানুষের জন্য উন্মুক্ত হলেও, দেশটির শিক্ষামন্ত্রী এপ্পো ব্রুইনস মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পরিস্থিতিকে ইঙ্গিত করে বলেন, ‘বর্তমানে আন্তর্জাতিক মানের বিজ্ঞান প্রতিভার জন্য বিশ্বব্যাপী ব্যাপক চাহিদা রয়েছে।
একই সঙ্গে, ভূ-রাজনৈতিক পরিস্থিতি পরিবর্তন হচ্ছে, যা বিজ্ঞানীদের আন্তর্জাতিক গতিশীলতা বৃদ্ধি করছে।
ইউরোপের বেশ কয়েকটি দেশ আন্তর্জাতিক প্রতিভাকে আকর্ষণ করার চেষ্টা করছে।
আমরা চাই, নেদারল্যান্ডস এই প্রচেষ্টায় অগ্রণী ভূমিকা পালন করুক।’
এর আগে, ফ্রান্সের একস-মার্সেই বিশ্ববিদ্যালয় ‘সেফ প্লেস ফর সায়েন্স’ নামে একটি প্রকল্প শুরু করে।
এই প্রকল্পের অধীনে, তারা তিন বছরের জন্য মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের দুই ডজনেরও বেশি গবেষকের জন্য অর্থ বরাদ্দ করেছে।
বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রেসিডেন্ট এরিক বেরটন বলেন, ‘আমরা এমনটা করতে চাইনি।
আমরা গবেষকদের আকৃষ্ট করতে চাচ্ছি না।
তবে আমরা যা ঘটছে, তাতে উদ্বিগ্ন এবং আমাদের মনে হয়েছে, যুক্তরাষ্ট্রের সহকর্মীরা একটি বিপর্যয়ের মধ্য দিয়ে যাচ্ছেন।
আমরা তাদের জন্য এক ধরনের বৈজ্ঞানিক আশ্রয়স্থল তৈরি করতে চেয়েছি, যেখানে তাদের গবেষণায় কোনো বাধা আসবে না।’
এই প্রকল্পের ঘোষণার দুই সপ্তাহের মধ্যে, প্রায় ১০০ জন আবেদন করেছেন।
এদের মধ্যে ইয়েল, নাসা এবং স্ট্যানফোর্ডের গবেষকরাও রয়েছেন।
বেরটন জানিয়েছেন, প্রতিদিন প্রায় ১০টি আবেদন জমা পড়ছে, যেখানে জলবায়ু, স্বাস্থ্য বা সামাজিক বিজ্ঞান নিয়ে কাজ করা গবেষকদের সংখ্যাই বেশি।
বেরটন আশা প্রকাশ করেন, ইউরোপের অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়গুলোও গবেষকদের জন্য নিরাপদ স্থান তৈরি করবে।
তিনি বলেন, ‘আমার মনে হয়, আমরা একটি ঐতিহাসিক মুহূর্তের সাক্ষী।
এর দীর্ঘমেয়াদি গুরুতর প্রভাব সম্পর্কে আমাদের ধারণা রাখতে হবে।
ইউরোপকে এই সুযোগ কাজে লাগাতে হবে।’
VUB-এর এই পদক্ষেপ ট্রাম্প সরকারের নীতির বৈশ্বিক প্রভাবের স্বীকৃতিস্বরূপ।
বিশ্ববিদ্যালয়টি জানিয়েছে, তাদের দুটি গবেষণা প্রকল্প—একটি হলো তরুণ সমাজ ও ভুল তথ্য নিয়ে, অন্যটি যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপের মধ্যে আন্তঃআটলান্টিক সংলাপ নিয়ে—নীতিগত পরিবর্তনের কারণে বাতিল করা হয়েছে।
তথ্য সূত্র: দ্য গার্ডিয়ান