একাকীত্ব মানুষের জীবনকে কঠিন করে তোলে, বিশেষ করে যখন বয়স বাড়ে। বয়স্ক মানুষেরা যখন বন্ধু এবং আপনজনদের হারান, তখন একাকিত্ব আরও গভীর হয়।
আর্জেন্টিনার প্রবীণ নাগরিকরা, জীবনের এই কঠিন সময়ে, তাদের অভিজ্ঞতা এবং গল্পগুলো ভাগ করে নিতে অভিনব এক পথ খুঁজে বের করেছেন। তাঁরা তৈরি করেছেন একটি পডকাস্ট, যার নাম ‘নাইনটি অ্যান্ড কাউন্টিং’ (Ninety and Counting), যেখানে নব্বইোর্ধ্ব বৃদ্ধ-বৃদ্ধারা তাঁদের জীবনের নানা কথা শোনান।
এই উদ্যোগের শুরুটা হয় ৯৭ বছর বয়সী আলবার্তো চাবের হাত ধরে। বুয়েনস আইরেসের (Buenos Aires) নিজের বাড়ি থেকে একটি ভিডিও পোস্ট করে তিনি অন্যদের প্রতি আহ্বান জানান, জীবনের এই প্রান্তে এসে তাঁরা যেন একত্রিত হন এবং নিজেদের কথা বলেন।
আলবার্তোর এই ডাকে সাড়া দিয়ে এক হাজারের বেশি মানুষ এগিয়ে আসেন, যা ছিল তাঁর এবং তাঁর পরিবারের জন্য অভাবনীয়। “ভিডিওটি যেন একটা সুনামি তৈরি করেছিল। দেড় হাজার ইমেইল! বয়স্ক মানুষদের একসঙ্গে কথা বলার সত্যিই খুব প্রয়োজন ছিল,” – এমনটাই বলছিলেন আলবার্তো।
তাঁর এই ধারণা তরুণ প্রজন্মের কাছেও বেশ সাড়া ফেলেছিল। ২৬ বছর বয়সী সাংবাদিক গুয়াদালুপে কামুরাতি (Guadalupe Camurati) এগিয়ে আসেন, যিনি পডকাস্টের ধারণাটি বাস্তবায়নে আলবার্তোকে সাহায্য করেন।
এভাবেই জন্ম হয় ‘নাইনটি অ্যান্ড কাউন্টিং’-এর। এই পডকাস্টে প্রবীণ নাগরিকরা তাঁদের জীবনের নানা দিক নিয়ে আলোচনা করেন – কেউ নাচের স্মৃতিচারণ করেন, কেউ স্বাস্থ্যকর জীবনযাপনের কথা বলেন, আবার কেউ ভালোবাসার অনুভূতি প্রকাশ করেন।
পডকাস্টের অনেক ক্লিপ ‘নাইনটি অ্যান্ড কাউন্টিং’-এর ইন্সটাগ্রাম (Instagram) পেজেও শেয়ার করা হয়। গত বছরের আগস্ট মাস থেকে এর যাত্রা শুরু হয়।
বর্তমানে, আলবার্তো প্রতি দুই সপ্তাহে সহ-প্রবীণদের সঙ্গে মিলিত হন এবং পডকাস্টের বিষয়বস্তু নিয়ে আলোচনা করেন। তাঁদের আলোচনা যেন জীবনের প্রতিচ্ছবি। এখানে উঠে আসে অতীতের অনেক কথা।
পুরনো দিনের ক্যান্ডি থেকে শুরু করে, কিভাবে তারা একসময় সরাসরি দুধ খেতেন, কিংবা কিভাবে তাঁদের পুরনো দিনের স্মৃতিগুলো সময়ের সঙ্গে সঙ্গে বদলে গেছে, সেসব কিছুই তাঁরা আলোচনা করেন।
পডকাস্টের একটি পর্বে ৯৪ বছর বয়সী নেলিদা (Nelida) বলেন, “নাইনটি অ্যান্ড কাউন্টিং-এ স্বাগতম। পরিবার এবং বন্ধুদের সঙ্গে, যারা এখনও বেঁচে আছেন, তাঁদের সঙ্গে কাটানো সময় নিয়ে আমি খুব খুশি।”
আরেকটি ইন্সটাগ্রাম ক্লিপে দেখা যায়, ৮৫ বছর বয়সী এক নারী সাইকেল চালাচ্ছেন। তিনি বলেন, “আমি অবশেষে আমার স্বপ্ন পূরণ করতে পেরেছি – ভ্রমণ করছি।
আমার নাতনী স্বেচ্ছাসেবক হিসেবে কাজ করে আমাকে ভ্রমণে সাহায্য করেছে। আর্জেন্টিনায় অবসর জীবন কাটিয়ে ভ্রমণ করাটা আমার জন্য কঠিন ছিল। আমি স্পেন এবং ইংল্যান্ডে গিয়েছি। বয়স কোনো বাধা নয়, প্রয়োজন শুধু ইচ্ছাশক্তি।”
এই পডকাস্টের মাধ্যমে অংশগ্রহণকারীরা নতুন করে যেন জীবন খুঁজে পেয়েছেন। তাঁরা এখন তাঁদের পরিবারের সঙ্গে নিজেদের অভিজ্ঞতাগুলো ভাগ করে নিতে পারেন।
আগে সমাজের চোখে তাঁরা যেন একটু দূরে ছিলেন, তাঁদের কথা তেমন শোনা হতো না। কিন্তু এখন, তাঁদের বলার মতো অনেক গল্প আছে।
আলবার্তো মনে করেন, এই পডকাস্ট তাঁদের জীবনকে আরও সুন্দর করেছে। তিনি বলেন, “আগে নাতি-নাতনিরা এসে হয়তো বলত, ‘দাদু কেমন আছো? ভালো আছো?’ তারপর তারা মোবাইল ফোনে ব্যস্ত হয়ে যেত।
কিন্তু এখন, তাদের সঙ্গে কথা বলার মতো, জানানোর মতো অনেক কিছু আছে। এর মাধ্যমে বয়স্ক মানুষগুলোর মধ্যে পুনরায় সামাজিক সম্পর্ক তৈরি হয়েছে, যা আগে ছিল না।”
দীর্ঘ এবং আনন্দময় জীবনযাপনের উপায় নিয়েও এখানে আলোচনা হয়। ৯২ বছর বয়সী মাবেল (Mabel) বলেন, “নব্বই বছর পর্যন্ত বাঁচার টিপস হলো স্বাস্থ্যকর খাবার খাওয়া এবং নিজেকে ভালোবাসা, নিজেকে খুব ভালোবাসতে হবে।”
আরেকজন প্রবীণ, ৯৭ বছর বয়সী জুয়ান কার্লোস (Juan Carlos) তাঁর দীর্ঘ জীবনের কৃতিত্ব দেন সৃষ্টিকর্তাকে। তিনি বলেন, “আমি ৯৭ বছর বয়সে পৌঁছেছি, কারণ ঈশ্বর ভালো। আমি খেলাধুলা করিনি এবং ভালো খাবার উপভোগ করেছি।”
আলবার্তো জানান, পডকাস্ট তৈরি করার এই নতুন পথে তিনি এখনো অনেক কিছু শিখছেন। কারিগরি দিকগুলো গুয়াদালুপে দেখাশোনা করেন, তবে আলবার্তো নিজেও প্রযুক্তি নিয়ে কাজ করতে এবং আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স (AI) ব্যবহার করতে চাইছেন।
তথ্য সূত্র: সিএনএন (CNN)